অর্থ পড়ে আছে, তালিকা নেই

  • করোনায় কাজ হারানো শ্রমিকদের তিন মাস তিন হাজার করে টাকা দেওয়ার তহবিল দিচ্ছে ইইউ ও জার্মানি। শ্রম অধিদপ্তর তা বাস্তবায়ন করবে।

  • দুস্থ শ্রমিকদের সহায়তা দিতে ১ হাজার ১৩৫ কোটি টাকার সমান ১১ কোটি ৩০ লাখ ইউরো নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জার্মান সরকার বসে আছে।

  • ১০ লাখ শ্রমিককে সহায়তা দেওয়ার চিন্তা থেকে নীতিমালা জারি হলেও এখন ৫০ হাজার শ্রমিক পাওয়াই কষ্টকর হবে।

ফাইল ছবি
প্রথম আলো

টাকা আছে হাজার কোটির বেশি। এ টাকা বিদেশ থেকে সাহায্য হিসেবে এসেছে। আছেন বঞ্চিত ও কাজ হারানো শ্রমিক। কাজ হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন অনেক শ্রমিক। আর সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে অনেক দপ্তর আছে শ্রমিকদের কাছে টাকা পৌঁছাতে।

এত কিছু থাকার পরও কাজ হারানো শ্রমিকদের অর্থসহায়তা দেওয়ার কাজটি বাস্তবায়িত না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ, টাকা পাওয়ার যোগ্য লোকের একটি তালিকা করতে হবে। কিন্তু সেটি করতে এখন খুব একটা আগ্রহী না কারখানামালিকদের সমিতিগুলো। ফলে পুরো আয়োজনটিই মাঠে মারা যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

তিন মাস ধরে কর্মহীন শ্রমিকদের তিন হাজার টাকা করে দেওয়া হবে—তা ঠিক করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ‘রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকাশিল্পের কর্মহীন হয়ে পড়া ও দুস্থ শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন’ শীর্ষক নীতিমালার গেজেট প্রকাশ করেছে ৭ অক্টোবর। সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক নির্ধারণে আটটি মানদণ্ড ঠিক করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে রপ্তানিমুখী পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্পে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কর্মরত শ্রমিক, শারীরিকভাবে অক্ষম, প্রসূতিকল্যাণ সুবিধাবঞ্চিত সন্তান জন্মদানকারী, করোনা বা অন্য কোনো রাগে আক্রান্ত, শ্রম আইন–২০০৬ অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ পাওয়ার শর্তের আওতার বাইরে থাকা শ্রমিক, ছাঁটাই হওয়া ও বর্তমানে কর্মহীন, লে–অফ হওয়া কারখানার কর্মহীন শ্রমিক ও চলতি বছরের ৮ মার্চের পর চাকরি হারানো শ্রমিক। কোনো শ্রমিক এসব শর্তের যেকোনো একটি পূরণ করলেই সহায়তা পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।

কিন্তু যে শ্রমিকদের সহায়তা দেওয়া হবে, তাঁদের তালিকাই তৈরি হয়নি এখনো। কবে হবে এই তালিকা, তা–ও নিশ্চিত নয়। তালিকা তৈরির প্রাথমিক দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কারখানার, পরে চারটি সমিতির।

নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংক বা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে টাকা পাঠানোর কথা। করোনাভাইরাসের কারণে রপ্তানিমুখী পোশাক, চামড়াজাত ও পাদুকাশিল্পের কিছু কারখানা বন্ধ ও লে-অফ হয়ে যাওয়ায় শ্রমিকেরা যে বিপদে পড়েছেন, তাঁদের সহায়তা করতেই জারি করা হয় এই নীতিমালা। অথচ দুস্থ শ্রমিকদের সহায়তা দিতে ১ হাজার ১৩৫ কোটি টাকার সমান ১১ কোটি ৩০ লাখ ইউরো নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জার্মান সরকার বসে আছে।

কিন্তু যে শ্রমিকদের সহায়তা দেওয়া হবে, তাঁদের তালিকাই তৈরি হয়নি এখনো। কবে হবে এই তালিকা, তা–ও নিশ্চিত নয়। তালিকা তৈরির প্রাথমিক দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কারখানার, পরে চারটি সমিতির। সমিতিগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ), বাংলাদেশ নিট পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ), লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলএফএমইএবি) এবং বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএলএলএফইএ)।

জানা গেছে, ১০ লাখ শ্রমিককে সহায়তা দেওয়ার চিন্তা থেকে নীতিমালা জারি হলেও এখন ৫০ হাজার শ্রমিক পাওয়াই কষ্টকর হবে। আবার শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে নীতিমালা জারি হলেও পুরো কাজটি করে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। অর্থ বিভাগের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, নীতিমালা জারির আগে সবার সঙ্গে আলোচনা করেই চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন তাঁদের সহযোগিতা না করা সত্যিই দুঃখজনক।

চামড়াশিল্প মালিকদের সংগঠন বিএফএলএলএফইএ সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন হাজার টাকা করে দেওয়ার জন্য যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, আশঙ্কা হয় টাকাগুলো পড়ে থাকবে।’

কারখানাগুলো ছক অনুযায়ী বিজিএমইএর কাছে শ্রমিকদের তথ্য পাঠালে বিজিএমইএ তা শ্রম অধিদপ্তরে পাঠিয়ে দেবে। এ ছাড়া বিজিএমইএর সদস্য কারখানাগুলোকে শ্রমিকদের হালনাগাদ তালিকা পাঠানোর কথা বলা হচ্ছে।
বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক

রানা প্লাজা ধসের পর বিজিএমইএ যেমনই হোক শ্রমিকদের একটি তথ্যভান্ডার করলেও বিকেএমইএ এখনো তা করেনি বলে জানা গেছে। তথ্যভান্ডার তৈরির আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকার কারণে এমনটি হয়েছে বলে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের পর্যবেক্ষণে এসেছে।

বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক এ নিয়ে বলেন, কারখানাগুলো ছক অনুযায়ী বিজিএমইএর কাছে শ্রমিকদের তথ্য পাঠালে বিজিএমইএ তা শ্রম অধিদপ্তরে পাঠিয়ে দেবে। এ ছাড়া বিজিএমইএর সদস্য কারখানাগুলোকে শ্রমিকদের হালনাগাদ তালিকা পাঠানোর কথা বলা হচ্ছে।

দুই বছরের ৩ মাস শেষ

চলতি ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ এই দুই অর্থবছরের জন্য নীতিমালাটি করা হয়েছে। নীতিমালা জারি করতে করতেই কেটে গেছে চলতি অর্থবছরের তিন মাস। নীতিমালায় বলা হয়েছে, নির্বাচিত শ্রমিকেরা ৩ মাস ৩ হাজার করে সর্বোচ্চ ৯ হাজার টাকা পাবেন। তবে শ্রমিক যদি তিন মাসের মধ্যে আগের কারখানা বা নতুন কোনো কারখানায় চাকরি পেয়ে যান, তাহলে যে মাসে কাজে যোগ দেবেন, সেই মাস থেকে তিনি নগদ সহায়তা পাবেন না।

শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ কে এম মিজানুর রহমান বলেন, ‘নীতিমালা করা হয়েছে সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই। এখন তা বাস্তবায়নের পালা। ভালো হতো সমিতিগুলো যদি এরই মধ্যে তালিকাটি পাঠিয়ে দিত।’

আমাদের তথ্যভান্ডার অতটা কার্যকর নয়। ভালো হতো যদি বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য ছাড়া অন্য কারখানা শ্রমিকদের তথ্যভান্ডার করে সহায়তা দেওয়া হতো।
বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম

শ্রমিকশ্রেণির প্রতিনিধিত্ব নেই

নীতিমালায় বলা হয়েছে, কারখানাগুলোই উপকারভোগী শ্রমিকদের নির্বাচন করবে। তারা নির্বাচিত দুস্থ শ্রমিকের নাম, ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, ব্যাংক বা এমএফএসের হিসাব নম্বর, মুঠোফোন নম্বরসহ বিস্তারিত তথ্য সমিতির কাছে পাঠাবে। সমিতি তা পাঠাবে শ্রম অধিদপ্তরে। শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটি তা চূড়ান্ত করবে। টাকা দেওয়া হবে শ্রমিকদের ব্যাংক বা এমএফএস হিসাবে সরাসরি। শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিবের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের আরেকটি কমিটি এ কার্যক্রম নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করবে।

বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘আমাদের তথ্যভান্ডার অতটা কার্যকর নয়। ভালো হতো যদি বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য ছাড়া অন্য কারখানা শ্রমিকদের তথ্যভান্ডার করে সহায়তা দেওয়া হতো। আর যে সব শর্ত দেওয়া হয়েছে, তাতে এক লাখ শ্রমিক পাওয়া কঠিন হবে।’

বাস্তবায়ন পর্যায়ের কোথাও শ্রমিক সংগঠনকে রাখা হয়নি। এ কারণে শ্রমিক প্রতিনিধি যুক্ত করার দাবি জানিয়ে ৪ অক্টোবর শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানকে চিঠি দিয়েছে শ্রমিক সংগঠনের আন্তর্জাতিক জোটের দেশীয় অংশ ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিল (আইবিসি)।

চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘ইন্ডাস্ট্রিঅল গ্লোবাল ইউনিয়নের বৈশ্বিক প্রচারণার কারণে তহবিলটি এসেছে। অথচ তালিকা তৈরিসহ কোনো পর্যায়েই ইন্ডাস্ট্রিঅলের প্রতিনিধিত্ব নেই। আমাদের আশঙ্কা এর ফলে প্রকৃত কর্মহীন শ্রমিকেরা বঞ্চিত হবেন।’

আরও পড়ুন