আকাশছোঁয়া দাম, সংকটে পাটকল

ইতিমধ্যে অর্ধশতাধিক পাটকল বন্ধ হয়েছে। অনেক পাটকলমালিক তিন শিফটের পরিবর্তে এক শিফটে উৎপাদন চালাচ্ছেন।

অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে কাঁচা পাটের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। গত মাসে একপর্যায়ে প্রতি মণ কাঁচা পাটের দাম সাত হাজার টাকা ছুঁয়েছিল। বর্তমানে কিছুটা কমলেও বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার ৮০০ থেকে ৬ হাজার টাকায়। পাটের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে ইতিমধ্যে অর্ধশতাধিক পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক পাটকলমালিক তিন শিফটের পরিবর্তে এক শিফটে উৎপাদন চালাচ্ছেন। ছয় দিনের পরিবর্তে পাঁচ দিন উৎপাদন চালিয়েও টিকে থাকার চেষ্টা করছেন কোনো কোনো উদ্যোক্তা।

বেসরকারি পাটকলমালিকেরা বলছেন, কাঁচা পাটের দাম দ্বিগুণের বেশি হয়ে গেছে। পাটপণ্যের দামও আনুপাতিক হারে বেড়েছে। বিদেশি ক্রেতারা এত দাম দিতে রাজি নয়। ফলে ক্রয়াদেশ কমেছে। ক্রেতাদের অনেকে পাটের বিকল্প পণ্যের দিকে ঝুঁকছে। তাই কাঁচা পাটের দাম নিয়ন্ত্রণে শিগগিরই সরকারের কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন। দীর্ঘমেয়াদি নীতি-সহায়তাও দিতে হবে। অন্যথায় বেসরকারি পাট খাতের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

মান ও এলাকাভেদে কাঁচা পাটের দাম ভিন্ন ভিন্ন হয়। জুলাইয়ে বিক্রির মৌসুমের শুরুতে মণপ্রতি দাম ছিল ২০০০-২২০০ টাকা। দুই মাসের মধ্যে সেটি বেড়ে আড়াই হাজার টাকা হয়। গত মাসে একপর্যায়ে প্রতি মণ কাঁচা পাটের দাম ৭ হাজার টাকা ছুঁয়েছিল। বর্তমানে কিছুটা কমলেও ৬ হাজারের আশপাশে বিক্রি হচ্ছে। অথচ গতবার প্রতি মণের দাম ১৬০০-১৭০০ টাকা দিয়ে শুরু হয়ে পরে সেটি বেড়ে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছিল।

পাট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হোসেন আলী খোন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, মাঠপর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে ১৩ লাখ বেল পাট মজুত রয়েছে। বড় পাটকলের কাছে কাঁচা পাটের পর্যাপ্ত মজুত থাকলেও ছোটরা সমস্যায় পড়েছে। উৎপাদন কম হওয়ার কারণেই দাম বাড়তি বলে দাবি তাঁর।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে কী পরিমাণ পাট উৎপাদিত হয়, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বছরে সাধারণত গড়ে ৭৫ লাখ বেল কাঁচা পাট উৎপাদিত হয়। তবে খরা ও অতিবন্যার কারণে চলতি বছর উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ৫৫ লাখ বেল। দেশের বেসরকারি পাটকলের জন্যই প্রয়োজন ৬০ লাখ বেল কাঁচা পাট। আর গৃহস্থালি ব্যবহারের জন্য ৫ লাখ বেল। এমন ব্যাখ্যা দিয়ে গত সেপ্টেম্বরে পাটকলমালিকদের দুই সংগঠন কাঁচা পাট রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের দাবি জানায়। বাংলাদেশি কাঁচা পাটের বড় আমদানিকারক দেশ ভারত। তবে সরকারের উচ্চ মহল কাঁচা পাট রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সবুজসংকেত দেয়নি। এরপর ধাপে ধাপে কাঁচা পাটের দাম বাড়তে থাকে। দামের লাগাম টানতে পাট অধিদপ্তর অবৈধ মজুতকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। তবে দামে লাগাম টানা যায়নি।

কাঁচা পাটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে পাটকলগুলোর পাশাপাশি বহুমুখী পাটপণ্যের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোও বিপদে পড়েছে। জানতে চাইলে ক্রিয়েশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাশেদুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে দামে ক্রয়াদেশ নিয়েছি, সেই দামে কাঁচা পাট কিনতে পারছি না। ফলে নতুন করে ক্রয়াদেশ নিতে পারছি না।’ তিনি বলেন, পাটপণ্য নিত্যপ্রয়োজনীয় না হওয়ায় একটি পর্যায়ের পর বেশি দাম দেন না ক্রেতারা।

সারা দেশে পাটকলের সংখ্যা প্রায় তিন শ। তার মধ্যে বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) সদস্যসংখ্যা ২০০। বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) সদস্য ৮১। সমিতির বাইরেও বেশ কিছু পাটকল রয়েছে। এর বাইরে সরকারি ২২টি পাটকল গত জুলাই থেকে বন্ধ।

কিছুদিন আগেও বিজেএমএ ও বিজেএসএর সদস্য ২৮১ পাটকলের মধ্যে সচল ছিল ২০৯টি। তবে পুঁজির অভাবে কাঁচা পাট কিনতে না পারা ও কাঁচা পাটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে ক্রয়াদেশ না থাকায় ৪০টি পাটকল বন্ধ হয়েছে। বাকিরা উৎপাদনক্ষমতা কমিয়ে এনেছে।

জানতে চাইলে বিজেএমএর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারি প্রথম আলোকে বলেন, আগামী মৌসুমের আগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অধিকাংশ পাটকল তিন শিফটের জায়গায় এক শিফটে উৎপাদন চালাচ্ছে। যারা পারেনি, তারা বন্ধ করে দিয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকার যদি পাট খাতকে নীতিসহায়তা ও আগামী মৌসুমে কাঁচা পাট কেনার জন্য উদ্যোক্তাদের স্বল্পসুদে তহবিল না দেয়, তাহলে অনেক পাটকলই উৎপাদনে ফিরতে পারবে না।

পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির ৭০ শতাংশই হচ্ছে পাটের সুতা। সেই সুতা কার্পেট তৈরিতে বেশি ব্যবহৃত হয়। কাঁচা পাটের দাম অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতারা ঝুট কাপড়, তুলা ও পিপি সুতার দিকে ঝুঁকছেন। দ্রুত কাঁচা পাটের দাম নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে পাটের সুতার বিকল্প পণ্যগুলো স্থায়ীভাবে জায়গা দখল করবে বলে মনে করছেন পাটকলমালিকেরা।

জানতে চাইলে বিজেএসএর চেয়ারম্যান মো. জাহিদ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, উৎপাদন কম হলেও বেশি দাম দিলেই কাঁচা পাট পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে কাঁচা পাটের ব্যবসাটি বর্তমানে মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে চলে গেছে। অন্য খাতের ব্যবসায়ীরাও চলে এসেছে। তিনি বলেন, পাট উৎপাদনের সঠিক তথ্য-উপাত্ত না থাকায় কোনো সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনা করা যায় না। সরকারকে মাঠপর্যায় থেকে উৎপাদনের যথাযথ পরিসংখ্যান আনতে হবে। বাজারে নজরদারি বাড়াতে হবে।