আয়োডিনের সরবরাহ কম, সংকটে লবণ ব্যবসায়ীরা

লবণ চাষ করছেন শ্রমিকেরা
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

এক মাস ধরে খাওয়ার লবণে মিশ্রণের জন্য প্রয়োজনীয় আয়োডিনের সরবরাহ ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, চাহিদা অনুযায়ী আয়োডিন সরবরাহ করছে না শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। এভাবে সংকট চলতে থাকলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের কারখানাগুলোতে লবণের উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

লবণে পটাশিয়াম আয়োডাইড বা আয়োডিন ব্যবহার করে তা খাওয়ার উপযোগী করা হয়। কিন্তু দেশে আয়োডিন সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর। এ জন্য ১৯৮৯ সাল থেকে একটি প্রকল্পের আওতায় আয়োডিন আমদানি ও সরবরাহের কাজ করে আসছে বিসিক।

আমাদের জানামতে, সাত-আট মাস আগে আয়োডিনের সর্বশেষ চালান এনেছিল বিসিক। যেটা এখন শেষ হওয়ার পথে বা শেষ হয়েছে। শেষ হওয়ার এক-দুই মাস আগেই নতুন আয়োডিন আনা উচিত ছিল বিসিকের। সেটি আনতে না পারায় আয়োডিনের সংকট তৈরি হয়েছে।
নুরুল কবির, সভাপতি, বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতি

আয়োডিন সরবরাহে ঘাটতির কথা বিসিকের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের কাছে সরাসরি স্বীকার না করলেও নিয়ন্ত্রণ করার কথা জানান। তবে তাঁদের কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। প্রত্যেকেই বিষয়টি নিয়ে বিসিকের চেয়ারম্যান মুহ. মাহবুবর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে পরামর্শ দেন। তাঁর বক্তব্য নিতে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বিসিক কার্যালয়ে গত দুই দিনে (মঙ্গল ও বুধবার) প্রায় ৫ ঘণ্টা চেষ্টা করা হয়। তবে সংস্থাটির চেয়ারম্যান বিষয়টি নিয়ে কথা বলেননি।

লবণ মিলগুলোতে আয়োডিনের সংকট নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল কবির গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের জানামতে, সাত-আট মাস আগে আয়োডিনের সর্বশেষ চালান এনেছিল বিসিক। যেটা এখন শেষ হওয়ার পথে বা শেষ হয়েছে। শেষ হওয়ার এক-দুই মাস আগেই নতুন আয়োডিন আনা উচিত ছিল বিসিকের। সেটি আনতে না পারায় আয়োডিনের সংকট তৈরি হয়েছে।’ বাজারে সরবরাহ ঠিক রাখতে প্রয়োজনে আয়োডিন ছাড়াই কিছুদিচলতি মৌসুমে দেশে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৩ লাখ ৫৬ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে ১৪ মার্চ পর্যন্ত লবণ উৎপাদিত হয়েছে মাত্র ৮ লাখ ৩৭ হাজার মেট্রিক টন, অর্থাৎ তিন ভাগের এক ভাগ।ন লবণ প্রক্রিয়াজাত করার দাবি জানান তিনি।

চলতি মৌসুমে দেশে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৩ লাখ ৫৬ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে ১৪ মার্চ পর্যন্ত লবণ উৎপাদিত হয়েছে মাত্র ৮ লাখ ৩৭ হাজার মেট্রিক টন, অর্থাৎ তিন ভাগের এক ভাগ।

লবণ উৎপাদনের মৌসুম হচ্ছে নভেম্বর থেকে মে মাস। চলতি মৌসুমে দেশে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৩ লাখ ৫৬ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে ১৪ মার্চ পর্যন্ত লবণ উৎপাদিত হয়েছে মাত্র ৮ লাখ ৩৭ হাজার মেট্রিক টন, অর্থাৎ তিন ভাগের এক ভাগ। সময় আছে আরও আড়াই মাস।

এসিআই সল্টের পরিচালক (ব্যবসায়) কামরুল ইসলাম বলেন, ‘বিসিক আমাদের এক মাস ধরে ঠিকমতো আয়োডিন দিচ্ছে না। সংস্থাটির এক কর্মকর্তা আমদানি বন্ধ আছে বলছেন, তো আরেকজন বলছেন বন্ধ নেই। চাইলে অল্প পরিমাণে আয়োডিন দেয়, যা দিয়ে দু-তিন দিন চলে। এ জন্য প্রায় প্রতিদিনই আমাদের লোককে বিসিক কার্যালয়ে গিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে। দেশে যে আয়োডিনের গুরুতর সংকট চলছে, তা তাঁরা স্বীকার করছেন না।’ সে জন্য তাঁর প্রশ্ন, ‘বিসিকের কাছে আয়োডিন থাকলে আমাদের দিচ্ছে না কেন?’

আমাদের কারখানায় যে আয়োডিন আছে, তা দিয়ে ১৫ দিনের মতো চালানো যাবে। আয়োডিনের মজুত কম আছে বলে বিসিক আমাদের জানিয়েছে। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে আমরা নিজেরাই আয়োডিন আমদানির অনুমতি পেতে বিসিকের কাছে আবেদন করেছি।
মান্নান মোল্লা, মহাব্যবস্থাপক (জিএম), মোল্লা সল্ট

ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে বছরে আয়োডিনযুক্ত অর্থাৎ খাওয়ার লবণ লাগে প্রায় ৯ লাখ টন। প্রতি টন লবণ পরিমিত মাত্রায় আয়োডিনযুক্ত করতে প্রায় ৫৫ গ্রাম পটাশিয়াম আয়োডাইড প্রয়োজন হয়। সেই হিসাবে প্রতিবছর ৪০ টনের বেশি আয়োডিন লাগে। তবে সরকারি নিয়মের কারণে বেসরকারিভাবে আয়োডিন আমদানির সুযোগ নেই।

মোল্লা সল্টের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মান্নান মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কারখানায় যে আয়োডিন আছে, তা দিয়ে ১৫ দিনের মতো চালানো যাবে। আয়োডিনের মজুত কম আছে বলে বিসিক আমাদের জানিয়েছে। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে আমরা নিজেরাই আয়োডিন আমদানির অনুমতি পেতে বিসিকের কাছে আবেদন করেছি।’

জাতীয় লবণনীতি ও আয়োডিনের অভাবজনিত রোগ প্রতিরোধ আইন অনুসারে, আয়োডিন মেশানো ছাড়া কোনো ধরনের ভোজ্য লবণ উৎপাদন, গুদামজাত, বিতরণ বা প্রদর্শন করা যাবে না। সে কারণে আয়োডিন সরবরাহ না পেলে লবণ উৎপাদন বন্ধ করা ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় থাকবে না বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সহসভাপতি ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের কারখানায় আয়োডিনের সংকট আছে। বিসিক আমাদের দ্রুত আয়োডিন সরবরাহের আশ্বাস দিলেও গত এক মাসে আমরা চাহিদামতো তা পাইনি।’ তিনি বলেন, ‘বিশ্ববাজারে তো আয়োডিনের সংকট নেই, তাহলে আমরা কেন পাচ্ছি না?’

বিসিক আমাদের চাহিদামতো আয়োডিন দিচ্ছে না। আমরা বিসিকের কাছে আয়োডিন চাইলে তারা জানায়, পর্যাপ্ত আয়োডিন নেই।
মারুফ হোসেন, নির্বাহী পরিচালক, কনফিডেন্স সল্ট

সমিতি জানায়, সারা দেশে ৩০০-এর বেশি লবণ মিল রয়েছে। তার মধ্যে আধুনিক প্রযুক্তির ৫টি—এসিআই, মোল্লা, ফ্রেশ, কনফিডেন্স ও এসএ সল্ট। মিলগুলোর অধিকাংশই চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও নারায়ণগঞ্জ এলাকায়।

চাহিদা অনুযায়ী আয়োডিন সরবরাহ না পাওয়ার অভিযোগ করলেন কনফিডেন্স সল্টের নির্বাহী পরিচালক মারুফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘বিসিক আমাদের চাহিদামতো আয়োডিন দিচ্ছে না। আমরা বিসিকের কাছে আয়োডিন চাইলে তারা জানায়, পর্যাপ্ত আয়োডিন নেই।’

বিষয়টি নিয়ে বিসিকের শিল্প উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ জাকির হোসেন এবং উপমহাব্যবস্থাপক ও লবণ সেলের প্রধান সরোয়ার হোসেনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করলেও তাঁরা আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। বিসিক সচিব মো. মফিদুল ইসলামও কিছু বলতে চাননি।