ইউরোপে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে উদ্যোক্তারা চিন্তায়

অনেক দেশেই বড়দিনের বিক্রিতে ধস নেমেছে। নতুন ক্রয়াদেশও আসছে কম। আবার তৈরি করা পণ্যের জাহাজীকরণও পিছিয়ে দিচ্ছেন ক্রেতারা।

তৈরি পোশাক কারখানা।
ফাইল ছবি

যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন (স্ট্রেইন) ছড়িয়ে পড়ার পর আতঙ্কে রয়েছে পুরো ইউরোপ। তার আগেই মহামারি ভাইরাসটির দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ কড়া লকডাউন জারি করে। অনেক দেশেই বড়দিন সামনে রেখে পণ্য বিক্রিতে ধস নেমেছে। নতুন ক্রয়াদেশও আসছে কম। আবার প্রস্তুত হওয়া পণ্যের জাহাজীকরণও পিছিয়ে দিচ্ছেন ক্রেতারা। ফলে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা।

কয়েকজন উদ্যোক্তা জানান, বসন্ত ও গ্রীষ্মের ক্রয়াদেশ আসার সময় মূলত অক্টোবর থেকে জানুয়ারি। কিন্তু ইউরোপের দেশে দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ও লকডাউনের কারণে দুই মাস ধরে নতুন ক্রয়াদেশ কম আসছে। তাতে আগামী বসন্ত ও গ্রীষ্মের পোশাক রপ্তানি ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। তবে এখনো চলমান ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়নি।

করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ছড়িয়ে পড়ায় ইউরোপের অনেক দেশ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সব সীমান্ত বন্ধ করেছে। এতে যুক্তরাজ্য কার্যত ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সংক্রমণ রোধে যুক্তরাজ্যে এখন কড়া লকডাউন চলছে। এর আগে থেকেই ইতালি, স্পেন, জার্মানি, ডেনমার্ক ও ফ্রান্স বিভিন্ন পন্থায় জনসমাগমের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেছে। যারা এখনো লকডাউনের ঘোষণা দেয়নি, তারাও খুব শিগগির তা করবে বলে আভাস দিচ্ছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।

জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক বলেন, পরিস্থিতি প্রতিদিন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। নতুন ক্রয়াদেশ আসা কমে গেছে। ক্রেতারা ক্রয়াদেশ নিয়ে কোনো প্রকার দর–কষাকষিও করছেন না। প্রস্তুত হওয়া পোশাক শিপমেন্ট দু–তিন সপ্তাহ পিছিয়ে দিচ্ছেন ক্রেতারা। তিনি বলেন, ইউরোপে বড়দিনের ছুটি শুরু হয়ে গেছে। পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, সেটি আগামী কয়েক দিন জানাও যাবে না।

ইউরোপের যেসব দেশ করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত, সেগুলো বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের বড় বাজার। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে জার্মানিতে ৪৭৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রপ্তানি। এ ছাড়া গত অর্থবছর যুক্তরাজ্যে ৩১৭, স্পেনে ২০২, ফ্রান্সে ১৫৬, ইতালিতে ১১৯ ও ডেনমার্কে ৬২ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়।

উদ্যোক্তারা জানান, তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ দেওয়ার কয়েকটি ধাপ রয়েছে। চূড়ান্ত পর্যায়ের ক্রয়াদেশ দেওয়ার আগে বস্ত্রকলে কাপড়ের কার্যাদেশ প্রদান ও নমুনা (স্যাম্পল) অনুমোদন উল্লেখযোগ্য। করোনার কারণে সেসব স্থগিত করছেন ক্রেতারা। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আগামী এক মাসের মধ্যে পোশাকের চূড়ান্ত ক্রয়াদেশ স্থগিত করতে পারেন তাঁরা।

বর্তমান পরিস্থিতিতে বসন্ত ও গ্রীষ্মের ক্রয়াদেশ ১৫-২০ শতাংশ কমবে। তা ছাড়া বড়দিনের কেনাকাটায় ধস নামায় সব ক্রেতার কাছেই পোশাকের মজুত রয়ে যাবে।
আরশাদ জামাল, বিজিএমইএর সহসভাপতি

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে আগামী এপ্রিল-মে পর্যন্ত বাংলাদেশের পোশাক খাতকে কঠিন সময় পার করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি আরশাদ জামাল। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বসন্ত ও গ্রীষ্মের ক্রয়াদেশ ১৫-২০ শতাংশ কমবে। তা ছাড়া বড়দিনের কেনাকাটায় ধস নামায় সব ক্রেতার কাছেই পোশাকের মজুত রয়ে যাবে। সে কারণে আগামী শীতে ক্রয়াদেশ কম দেবেন ক্রেতারা। সেটি হলে আগামী বছর পোশাক রপ্তানি ৩০-৩৫ শতাংশ কমবে।

করোনার প্রথম ঢেউয়ে ক্রয়াদেশ বাতিল এবং কারখানা বন্ধ থাকায় গত এপ্রিলে পোশাক রপ্তানিতে ধস নামে। ওই মাসে মাত্র ৩৭ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। পরের মাসে হয় ১২৩ কোটি ডলারের। তাতে গত অর্থবছর পোশাক রপ্তানি কমে ১৮ শতাংশ। রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭৯৪ কোটি ডলার। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে ঘুরে দাঁড়াতে থাকে পোশাক রপ্তানি। প্রথম পাঁচ মাসে ১ হাজার ২৮৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে দেড় শতাংশ কম।

নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘লকডাউনের কারণে ইউরোপের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা গৃহবন্দী অবস্থায় আছেন। তাঁরা ক্রয়াদেশ দেওয়ার কোনো চিন্তাভাবনা করছেন না। এদিকে ক্রয়াদেশ দেওয়ার সময়সীমাও প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফলে আমরা অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে আছি।’