মুক্তিযুদ্ধের পর ঋণের দায় নিয়ে যেভাবে সমঝোতা হয়েছিল

স্বাধীনতাযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতার কাছে ঋণের দায়দেনা নিয়ে নতুন সংকট তৈরি হয়। পাকিস্তান আমলে নেওয়া ঋণের দায় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের কতটা নিতে হবে, এ নিয়ে চলে দীর্ঘ আলোচনা। দাতারা চেয়েছিল বাংলাদেশের ওপর বেশি ঋণের দায় চাপাতে, আর বাংলাদেশ এত ঋণের দায় নিতে রাজি ছিল না।

দীর্ঘ তিন বছরের আলোচনা শেষে ৩৫ কোটি ৬৬ লাখ ডলারের দায় নিতে রাজি হয় বাংলাদেশ; যা দাতাদের পক্ষ থেকে নেতৃত্বদানকারী সংস্থা বিশ্বব্যাংকের হিসাবের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ। ওই সময়ে বাংলাদেশে চলমান প্রকল্পগুলোকেই প্রাধান্য দিয়ে এই দায়দেনা ঠিক হয়েছিল।

এই দায়দেনা নিয়ে কী ধরনের নীতি গ্রহণ করা হবে, তা নিয়ে তৎকালীন সরকার তিন সদস্যবিশিষ্ট ঋণ কমিটি গঠন করেছিল। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান ওই কমিটিতে ছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় অবস্থান এবং ওই কমিটির দর-কষাকষির সক্ষমতায় একটি ভালো আপসরফা হয়েছিল।

অধ্যাপক নুরুল ইসলাম

স্বাধীনতার পর গঠিত প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। বাংলাদেশ: জাতি গঠনকালে এক অর্থনীতিবিদের কিছু কথা বইয়ে তিনি ‘পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণের দায় ভাগাভাগি: দাতাদের চাপ সৃষ্টির একটি উদাহরণ’ শিরোনামে ওই সময়ের কিছু স্মৃতিচারণা করেন।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন জরুরি হয়ে পড়েছিল। বিদেশি সহায়তাও দরকার পড়ে। এমন অবস্থায় ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সদস্যপদের জন্য আবেদন করে বাংলাদেশ। আগস্ট মাসে সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশ। সদস্যপদ নিয়ে আলোচনার শুরুতে পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণ ভাগাভাগি করে নেওয়ার বিষয়টি উত্থাপন করা হয়।

পাকিস্তান আমলের যেসব প্রকল্প চালু ছিল, তা নতুন করে চালুর আলোচনা শুরু করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এসব প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব স্বীকার করে নেয়। যেসব প্রকল্প নতুন করে চালুর বিষয়ে বাংলাদেশ রাজি ছিল না, সে ব্যাপারে দাতাদের জানিয়ে দেওয়া হয়, কোন কোন প্রকল্প পুনরায় শুরু হবে এবং কী ধরনের শর্তে শুরু হবে, তা নিয়ে বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নেবে। তখন এ নিয়ে কয়েকজন বিশ্বখ্যাত আইন বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়া হয়। তাঁরা মত দিয়েছিলেন, পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণের দায় ভাগ করে নিতে বাধ্য নয় বাংলাদেশ।

এ বিষয়ে নুরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘সামগ্রিক বিষয়ে আমরা দুটি সহজ যুক্তি উপস্থাপন করি। এক, যেহেতু পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং আইনানুযায়ী বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অংশ মনে করে, সেহেতু পাকিস্তানের বকেয়া ঋণ বাংলাদেশের পক্ষে ভাগ করে নেওয়া সম্ভব নয়। দুই, বাংলাদেশকে যখন স্বীকৃতি দেবে, তখন পাকিস্তানের সঙ্গে আমরা আলোচনায় বসতে পারি। আলোচনায় আন্তআঞ্চলিক ও বৈদেশিকসহ সকল প্রকারের সম্পদ ও দেনা–পাওনা দুটি সমান সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভিত্তিতে মীমাংসা হতে পারে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণের দায় গ্রহণের বিষয়টি পাকিস্তানের সঙ্গে সার্বিক ও বিস্তারিতভাবে আর্থিক বিষয়ে বোঝাপড়ার সঙ্গে সম্পর্কিত।

’মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিপুল সম্পদ নষ্ট হয়, যা দেশের ঋণ পরিশোধের ক্ষমতাও নষ্ট করে। সমঝোতায় এই বিষয়টিও উঠে আসে। বাংলাদেশের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, তার হিসাব করলে পাকিস্তানের ঋণ পরিশোধের অংশ বাংলাদেশের ওপর কম বর্তায়।

অধ্যাপক নুরুল ইসলামের বইয়ে একটি হিসাব দেওয়া হয়। সেটি হলো পাকিস্তানের সামগ্রিক সম্পদে বাংলাদেশের অংশ ৪০০ কোটি ডলার। যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১০০ থেকে ১৫০ কোটি ডলার। সব মিলিয়ে পাওনা ৫০০ থেকে ৫৫০ কোটি ডলার।ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণের দায়দেনা পরিশোধের বিষয়ে পাকিস্তানের দিকেই ঝুঁকে ছিল দাতা সংস্থা ও দেশগুলো।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান
‘ঋণের দায়ভার এক-তৃতীয়াংশ নামিয়ে আনার পেছনে বাংলাদেশের দর-কষাকষির সক্ষমতাই বেশি ভূমিকা পালন করেছে।’
এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা।

এ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঋণের দায়দেনা বহনের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু অনমনীয় ভাব দেখান। ১৯৭৩ সালের দিকে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সুর নরম হতে থাকে।১৯৭৪ সালে দেশের অর্থনীতি সংকটে পড়ে। দাতাদের সাহায্য–সহযোগিতা দরকার হয়। এমন অবস্থায় ঋণের দায় ভাগ করে নিতে রাজি হয় বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, বাংলাদেশের ওপর ঋণের দায় ছিল ১২০ কোটি ডলার। শেষ পর্যন্ত এই দায় ৩৫ কোটি ৬৬ লাখ ডলারে সমঝোতা হয়।

বাংলাদেশের দর-কষাকষির সক্ষমতার কারণেই ঋণের দায়ভার কমেছে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণের দায়ভার এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনার পেছনে বাংলাদেশের দর-কষাকষির সক্ষমতাই বেশি ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীনতার আগে থেকেই অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলাম ও রেহমান সোবহানের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুখ্যাতি ছিল। বিশ্বব্যাংক তাঁদের সমীহ করত। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের বিশালতাও এ ক্ষেত্রে কাজে লেগেছে। বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক করলেও বাংলাদেশের অবস্থান অনড় ছিল। তখন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে গুণী মানুষেরা ছিলেন, তাঁদের কারণে দর-কষাকষিতে এগিয়ে থাকতে পেরেছি।’

তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার আগে দাতাদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের বেশি খরচ হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। আর ঋণ পরিশোধের বেশি অর্থ আসত পাট বিক্রির মাধ্যমে।