একটা চামড়াশিল্প নগরই শেষ হয়নি, আরেকটার তোড়জোড়

দেড় যুগ আগে নেওয়া সাভার চামড়াশিল্প নগর প্রকল্পটিই এখনো শেষ হয়নি। অথচ একই রকমের আরেকটি শিল্পনগর স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে বিসিক।

প্রথম আলো ফাইল ছবি

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়াশিল্প নগরে ট্যানারি স্থানান্তরের কাজ দীর্ঘ দেড় যুগেও শেষ করতে পারেনি। অথচ সংস্থাটি ওই শিল্পনগরের পাশে ২০০ একর জমিতে একই ধরনের আরেকটি চামড়াশিল্প পার্ক করার প্রস্তাব দিয়েছে।

বিসিকের প্রস্তাব অনুযায়ী, নতুন শিল্পনগরে ১৯০ উদ্যোক্তাকে প্লট দেওয়া হবে। সেখানে কর্মসংস্থান হবে এক লাখ মানুষের। এ প্রকল্পে ব্যয় হবে ৩ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা, যার পুরোটাই বহন করবে সরকার। ২০২৫ সালের মধ্যে কাজ শেষ হবে।

সরকারি সংস্থাটি ইতিমধ্যে নতুন শিল্পনগর স্থাপনের প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। জায়গাটি পড়েছে সাভার ও কেরানীগঞ্জ উপজেলায়। তবে এ প্রকল্প অনুমোদনের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশন কঠোর অবস্থানে রয়েছে। এর কারণ ব্যাখ্যা করে কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, বিসিকের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এর ওপর তারা যেখানে চামড়াশিল্প নগর করার প্রস্তাব দিয়েছে, সেখান থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ৯০০ একর জমিতে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। দেশে জমির প্রকট সংকটের পরিস্থিতিতে এত কম দূরত্বে দুটি সংস্থার জন্য এত জমি পাওয়া কঠিন হবে। সে জন্য সরকারের দুই সংস্থার অধীনে দুটি শিল্পাঞ্চল না করে বরং সমন্বয়ের তাগিদ দিয়েছে কমিশন।

হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারে নিতে দেরি হচ্ছে, এটা ঠিক। কিন্তু আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) কাজ শেষ করতে সক্ষম হয়েছি। আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি।
মোস্তাক হাসান, চেয়ারম্যান, বিসিক।

বিসিকের প্রস্তাবিত চামড়াশিল্প পার্ক নিয়ে ৭ এপ্রিল ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফর্মে এক আন্তমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) শরিফা খান বলেন, সরকার সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করছে। দেশে জমির স্বল্পতা বিবেচনা করে বেজার সঙ্গে সমন্বয় করে শিল্পপার্ক স্থাপন করা আবশ্যক।
বেজার উপসচিব নাজমুল আলম বলেন, বিসিক যেখানে চামড়া শিল্পপার্ক করার প্রস্তাব দিয়েছে, তার অদূরেই নবাবগঞ্জ এলাকায় বেজা একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করতে যাচ্ছে। বিসিক চাইলে সেখানে জমি নিয়ে শিল্প পার্ক স্থাপন করতে পারে। তাহলে নতুন করে জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন পড়বে না।

ওই সভায় পরিকল্পনা কমিশনের অতিরিক্ত সচিব বেগম কামরুন নাহার সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে প্রকল্পটি করা যায় কি না, সেটি পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা দরকার বলে মত দেন।

বিসিক এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সমীক্ষা করিয়েছে, যাদের নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট নই। এত বড় একটি প্রকল্প নেওয়ার আগে ভালো একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে বড় পরিসরে সমীক্ষা করতে বলেছি।
শরিফা খান, সদস্য (সচিব), পরিকল্পনা কমিশন

অর্থ বিভাগের উপসচিব নুরউদ্দিন আল ফারুক বলেন, বিভিদ অ্যাসোসিয়েটকে দিয়ে বিসিক যে সমীক্ষা করেছে, সেটি আংশিক। এর কারিগরি দিকও বিশ্লেষণ করা হয়নি। বিস্তারিত সমীক্ষা ছাড়া এত বড় প্রকল্প নেওয়া ঠিক হবে না।

ওই সভায় আরও বলা হয়, বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে বিসিকের অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে ট্যানারি, অর্থাৎ চামড়াশিল্প স্থানান্তরের কাজ শুরু হয় ২০০৩ সালে। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়নি। কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) চালু হয়নি। বর্জ্য ফেলার জায়গা ডাম্পিং ইয়ার্ডও করা যায়নি।

জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) শরিফা খান বলেন, ‘বিসিক এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সমীক্ষা করিয়েছে, যাদের নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট নই। এত বড় একটি প্রকল্প নেওয়ার আগে ভালো একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে বড় পরিসরে সমীক্ষা করতে বলেছি। এখনই এত বড় প্রকল্পে যাওয়া ঠিক হবে না।’

নতুন চামড়াশিল্প নগর করার পেছনে বিসিক অবশ্য কয়েকটি যুক্তি তুলে ধরেছে। বলেছে, চামড়াশিল্প নগর সাভারে সরিয়ে নেওয়ার পরও হাজারীবাগে বেশ কিছু চামড়াশিল্প ইউনিট রয়ে গেছে। চট্টগ্রাম, বগুড়াসহ দেশের অন্যান্য স্থানে বেশ কিছু কারখানা আছে। এ ছাড়া চামড়াজাত দ্রব্য ও ফুটওয়্যার শিল্পের ১৩০ জন প্লট পেতে আগ্রহ দেখিয়েছে। বিদেশি কয়েকটি উদ্যোক্তাও নতুন প্লট চায়। সব মিলিয়ে প্লটের জন্য আবেদন পড়েছে ১৯০টি। বর্তমানে সাভার চামড়াশিল্প নগরে বরাদ্দ দেওয়ার মতো কোনো জমি নেই। নতুন উদ্যোক্তাদের জমির ব্যবস্থা করতেই চামড়াশিল্প পার্ক স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

বিসিক বলছে, নতুন চামড়াশিল্প পার্ক হবে পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব। সেখানে শ্রমিকদের আবাসন, চামড়া ইনস্টিটিউট, শিশু সেবাযত্নকেন্দ্র থাকবে। স্কুল, হাসপাতাল, খেলার মাঠ, ক্লাব, ক্যানটিন, মিলনায়তন, মসজিদ ও ল্যাবরেটরি থাকবে। এ ছাড়া ব্যাংক, বিমা, ফায়ার সার্ভিসের সুবিধাও রাখা হবে।

জানতে চাইলে বিসিকের চেয়ারম্যান মোস্তাক হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তৈরি পোশাকশিল্পের আর এগোনোর সুযোগ নেই। চামড়া খাতের ধারেকাছেও অন্য কোনো শিল্প নেই। এত দিন এ খাতে কেউ নজর দেয়নি। দেশের ১৮ কোটি মানুষের জুতার জন্য এক লাখ উদ্যোক্তা প্রয়োজন। আমরা সেই সুযোগ করে দিতেই আরেকটি চামড়াশিল্প পার্ক করার উদ্যোগ নিয়েছি।’

বিসিক এখন আগের অবস্থানে নেই উল্লেখ করে মোস্তাক হাসান বলেন, ‘হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারে নিতে দেরি হচ্ছে, এটা ঠিক। কিন্তু আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) কাজ শেষ করতে সক্ষম হয়েছি। আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি।’

চামড়া খাতকে একসময় সম্ভাবনাময় মনে করা হলেও এটি যেন ধীরে ধীরে খারাপের দিকে যাচ্ছে। রপ্তানি কমে আসছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চামড়া খাতে রপ্তানি আয় ছিল ১২৩ কোটি ডলার, যা পরের ২০১৮–১৯ অর্থবছরে কমে ১০১ কোটি ডলারে নেমে আসে। এর পরের অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানি আয় আরও কমে ৮০ কোটি ডলারে নেমে গেছে। এভাবে একসময় দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি খাত এখন চতুর্থ স্থানে নেমে এসেছে।