এমন পতন কখনো দেখা যায়নি

গত এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত অর্থনীতি সবচেয়ে বেশি ভুগেছে। এই সময়ে শিল্পপণ্যের উৎপাদন ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কমেছে।

তিন মাসের চিত্র

  • তৈরি পোশাকের উৎপাদন কমেছে অর্ধেকের বেশি।

  • ৬ লাখ টন কম সিমেন্ট উৎপাদিত হয়েছে।

  • দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি ওষুধ উৎপাদিত হয়েছে।

অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব সবচেয়ে বেশি ছিল গত এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত। জুন মাসের শেষের দিকে অর্থনীতি খুলতে শুরু করে। কিন্তু ওই তিন মাসেই শিল্পপণ্য উৎপাদনে ধস নামে। তৈরি পোশাকের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসে। ইস্পাত, সিমেন্ট, সারের মতো বড় ও ভারী শিল্প খাতের উৎপাদন কমেছে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ।

গত মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাস পর্যন্ত বেশির ভাগ কলকারখানা বন্ধ ছিল কিংবা উৎপাদন কমিয়েছে। ওই সময়ে শিল্পপণ্যের উৎপাদন কত কমেছে—এত দিন সরকারি হিসাব মেলেনি। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) শিল্প উৎপাদনের তথ্য প্রকাশ করেছে। সেখানে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থায় কী ধরনের ক্ষত রেখেছে, এর চিত্র ফুটে উঠেছে। বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) উৎপাদন খাতের অবদান প্রায় ২০ শতাংশ।

স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে কেউ বাসা থেকে বের হননি। অপেক্ষাকৃত কম প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা ছিল না বললেই চলে। তখন পণ্য উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না। এপ্রিল, মে ও জুন মাসে অন্য বছরের তুলনায় উৎপাদন কমাটাই স্বাভাবিক।
এ কে খান গ্রুপের পরিচালক আবুল কাসেম খান

১৭টি খাত দিয়ে উৎপাদন খাতের চিত্র তুলে বিবিএস। এপ্রিল থেকে জুন সময়ে করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। চলাচল সীমিত করা হয়। এতে চাহিদা না থাকায় ওই পোশাক, রড, সিমেন্ট, সারসহ ১৫ ধরনের পণ্যের উৎপাদন কমেছে। শুধু ওষুধ ও সুরক্ষাসামগ্রীর উৎপাদন বেড়েছে।

দেশের খ্যাতনামা এ কে খান গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠান পোশাক–সংশ্লিষ্ট কারখানা বন্ধ ছিল। জুন-জুলাই মাস থেকে ওই সব কারখানা চালু হয়।

কেন কারখানা বন্ধ রেখেছিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে এ কে খান গ্রুপের পরিচালক আবুল কাসেম খান প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে কেউ বাসা থেকে বের হননি। অপেক্ষাকৃত কম প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা ছিল না বললেই চলে। তখন পণ্য উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না। এপ্রিল, মে ও জুন মাসে অন্য বছরের তুলনায় উৎপাদন কমাটাই স্বাভাবিক।

পোশাকের অর্ধেক উৎপাদন

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিল্পপণ্য হিসেবে তৈরি পোশাককে ধরা হয়। এটি আমাদের প্রধান রপ্তানিপণ্য এবং অর্থনীতির চালিকা শক্তি। গত এপ্রিল-জুন সময়ে তৈরি পোশাকের উৎপাদন অর্ধেকের বেশি কমেছে। বিবিএস বলছে, ওই সময়ে ৩২ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকার পোশাক উৎপাদন হয়েছে। ২০১৯ সালের একই সময়ে ৬৯ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকার পোশাক বানানো হয়েছিল। ফলে পোশাক রপ্তানিতেও ব্যাপক ধস নামে। গত এপ্রিল মাসে আগের বছরের এপ্রিল মাসের চেয়ে ৮৩ শতাংশ রপ্তানি কমে যায়। মে মাসে কমে প্রায় ৬২ শতাংশ। জুন মাসে কমে ২ শতাংশের মতো। টানা তিন মাস এমন নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি আর কখনোই হয়নি।

ভারী শিল্পে ধস

রড-সিমেন্ট, সারের মতো ভারী শিল্প উৎপাদনে বেশ প্রভাব রেখেছে করোনা। রডের উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। গত এপ্রিল-জুন সময়ে ৫৬ হাজার টন রডের উৎপাদন হয়েছে। ২০১৯ সালের ওই সময়ে রডের উৎপাদনের পরিমাণ ছিল এক লাখ টনের বেশি।

এপ্রিল-জুন সময়ে ৩৬ লাখ টন সিমেন্ট উৎপাদন হয়েছে। অন্যদিকে সারের উৎপাদনও অর্ধেকে নেমেছে। ২০১৯ সালের মার্চ-জুন প্রান্তিকে ১ লাখ ৯১ হাজার টন সার উৎপাদন হয়েছিল। এবার তা কমে ৯৩ হাজার টনে নেমেছে।

ওই তিন মাসে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ লাখ টন কম সিমেন্ট উৎপাদন হয়েছে। এপ্রিল-জুন সময়ে ৩৬ লাখ টন সিমেন্ট উৎপাদন হয়েছে। অন্যদিকে সারের উৎপাদনও অর্ধেকে নেমেছে। ২০১৯ সালের মার্চ-জুন প্রান্তিকে ১ লাখ ৯১ হাজার টন সার উৎপাদন হয়েছিল। এবার তা কমে ৯৩ হাজার টনে নেমেছে।

ওষুধ ও সুরক্ষাসামগ্রীর চাহিদা বেশি ছিল

কোভিড–১৯ থেকে রক্ষার উপায় বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া কিংবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা। তাই এসব পণ্যের চাহিদাও হু হু করে বেড়ে যায়। ওষুধ ও সাবান, ডিটারজেন্টের উৎপাদন বেড়ে যায়। গত এপ্রিল-জুন সময়ে আগেরবারের চেয়ে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি ওষুধ উৎপাদন করে ওষুধ কোম্পানিগুলো। ওই সময়ে ৬ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকার ওষুধ উৎপাদন হয়। সাবান ও ডিটারজেন্টের উৎপাদন বেড়েছে আড়াই হাজার টন। ওই সময়ে সাবান ও ডিটারজেন্ট উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ৬০৩ টন।

চা-সিগারেটের চাহিদাও কমেছে

চায়ের দোকানে আড্ডা ছিল না। সবাই যেন সংঘ নিরোধেই ব্যস্ত ছিলেন। ফলে এপ্রিল-জুন সময়ে ৫০ লাখ শলাকা কম সিগারেট তৈরি করেছে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। চায়ের উৎপাদন কমেছে প্রায় ৬ হাজার টন।