বিদ্যুৎ–সংকটের কারণে চীনে শিল্পকারখানার উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে তাদের শিল্প কার্যক্রমের ৪৪ শতাংশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বিদ্যুৎ-সংকট। ফলে চীনে কাঁচামালের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এমনকি দেশটি থেকে সময়মতো কাঁচামাল পাওয়া নিয়েও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা।
এদিকে কাঁচামাল নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকলেও চীনের বর্তমান সংকটের কারণে তৈরি পোশাক খাতে ক্রয়াদেশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পমালিকেরা। আবার সময়মতো কাঁচামাল না পেলে বর্তমান ক্রয়াদেশের পণ্য সময়মতো রপ্তানি করা যাবে না এবং তাতে পরিস্থিতি বেশ জটিল আকার ধারণ করবে বলেও আশঙ্কা তাঁদের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩ হাজার ১৪৫ কোটি মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। একই সময়ে কাঁচামাল আমদানি হয়েছে ১ হাজার ২৮৫ কোটি ডলারের, যার বড় অংশই চীন থেকে আমদানি হয়েছে।
বিবিসি ও ইকোনমিস্টসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, চীনের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় ১৯টি প্রদেশে কয়েক দিন ধরেই বড় ধরনের বিদ্যুৎ-সংকট চলছে। শুরুতে কলকারখানা বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে। পরে আবাসিক এলাকাও বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমনকি উত্তরাঞ্চলের তিয়ানজিনে অবস্থিত চীনের বৃহত্তম বন্দরটিও বিদ্যুৎ–ঘাটতির মুখে পড়ে গেছে। কয়েকটি প্রদেশে পালা (রেশনিং) করে বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে। ১০টির মতো প্রদেশে কলকারখানায় বিদ্যুৎ ব্যবহারের বিষয়ে বিধিনিষেধও আরোপ করা হয়েছে। তাতে অনেক কারখানা উৎপাদন সীমিত করতে বা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।
চীনে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান না হলে বাংলাদেশের ওভেন পোশাক রপ্তানিকারকেরা বিপদে পড়বেন। কারণ, ৬০ শতাংশ ওভেন কাপড়ই চীন থেকে আসে।
চীনে বিদ্যুৎ উৎপাদন কয়লার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ব্যাপক হারে হ্রাস করতে সরকার কড়াকড়ি আরোপ করায় কয়লা উৎপাদন কমেছে। অন্যদিকে করোনা সংক্রমণের হার কমায় চীনা পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহের ওপর বাড়তি চাপ পড়েছে। এদিকে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কয়লার দামও বেড়ে গেছে। তবে চীনা সরকার বিদ্যুতের দাম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই কয়লাভিত্তিক অনেক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানি লোকসানে তাদের উৎপাদন চালাতে চাইছে না। সে জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩ হাজার ১৪৫ কোটি মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। একই সময়ে কাঁচামাল আমদানি হয়েছে ১ হাজার ২৮৫ কোটি ডলারের, যার বড় অংশই চীন থেকে আমদানি হয়েছে।
জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যে চীনে বিদ্যুৎ–সংকটের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ওভেন কাপড়ের বেশ কিছু ক্রয়াদেশ চীনা ব্যবসায়ীরা চূড়ান্ত করেননি। তাঁরা হ্যাঁ বা না কিছুই বলছেন না। এর মানে হচ্ছে তাঁদের দেশে সমস্যা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ-সংকট তিন প্রদেশে বেশি। ফলে বর্তমান ক্রয়াদেশের পণ্য পাওয়া নিয়ে খুব একটা সমস্যা হবে না। তবে ভবিষ্যতের ক্রয়াদেশ নিয়ে কিছুটা জটিলতা হতে পারে।
শহিদউল্লাহ আজিম আরও বলেন, চীনে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান না হলে বাংলাদেশের ওভেন পোশাক রপ্তানিকারকেরা বিপদে পড়বেন। কারণ, ৬০ শতাংশ ওভেন কাপড়ই চীন থেকে আসে। সময়মতো কাপড় না এলে রপ্তানিও হবে না।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো বিপুলসংখ্যক মানুষকে করোনার টিকা দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে। তাই সেসব দেশের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো আগামী গ্রীষ্ম ও বসন্ত মৌসুমের জন্য করোনার আগের মতো ক্রয়াদেশ দিচ্ছে। তা ছাড়া মিয়ানমারে সেনাশাসন ও ভারতে করোনার ভয়াবহতার কারণেও বাড়তি কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হচ্ছে। তারও আগে চীন থেকে কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে স্থানান্তর করে আসছিলেন ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারা। সাম্প্রতিক কালে ভিয়েতনামে বিধিনিষেধ থাকার কারণেও কিছু ক্রয়াদেশ আসছে। সব মিলিয়ে ২০১৯ সালের তুলনায় ১৫-২০ শতাংশ ক্রয়াদেশ বেশি এসেছে।
পোশাকের ক্রয়াদেশ আসার সম্ভাবনা থাকলেও চীনের বর্তমান সংকটের কারণে বাংলাদেশ সেই সুযোগ নিতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল্লাহ হিল রাকিব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কারখানাগুলো প্রায় ক্রয়াদেশে ভরপুর। ফলে নতুন ক্রয়াদেশ নেওয়া কঠিন। আরেকটি বিষয় হচ্ছে জাহাজ ভাড়া অনেক বেড়ে গেছে। ফলে বাংলাদেশ থেকে দামে কিছুটা সস্তা পেলেও সেই তুলনায় তুরস্কসহ অন্য অনেক দেশে ক্রয়াদেশ দিলে জাহাজভাড়ার কারণে দাম কম পড়ছে। তাই নতুন ক্রয়াদেশ নয়, বরং চীন থেকে সময়মতো কাঁচামাল পেলেও আমাদের উদ্যোক্তারা বেঁচে যাবেন।’
করোনার প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে পোশাক রপ্তানি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গত জুনে শেষ হওয়া ২০২০–২১ অর্থবছরে ৩ হাজার ১৪৫ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে সাড়ে ১২ শতাংশ বেশি। চলতি ২০২১–২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে অবশ্য প্রবৃদ্ধি ভালো হয়নি। তবে আগস্টে আবার ২৭৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে সাড়ে ১১ শতাংশ বেশি।
এদিকে পোশাকের মতো অন্যান্য খাতের ব্যবসায়ীরাও দুশ্চিন্তায় আছেন। চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ম্যাফ শুজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসনাত মোহাম্মদ আবু ওবায়দা প্রথম আলোকে বলেন, চীনে প্রতি সপ্তাহে কাঁচামালের দাম ১৫-২০ শতাংশ হারে বাড়ছে। কনটেইনার ভাড়াও বেড়ে গেছে। সেই তুলনায় ক্রেতারা বাড়তি অর্থ দিতে চাইছেন না। ফলে পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ–চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) সহসভাপতি এ টি এম আজিজুল আকিল অবশ্য প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎ-সংকট তিন প্রদেশে বেশি। ফলে বর্তমান ক্রয়াদেশের পণ্য পাওয়া নিয়ে খুব একটা সমস্যা হবে না। তবে ভবিষ্যতের ক্রয়াদেশ নিয়ে কিছুটা জটিলতা হতে পারে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ-সংকটের প্রভাব এখনো প্রকট না হলেও কনটেইনার ভাড়া নিয়ে ভোগান্তির মধ্যে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ইতিমধ্যে কনটেইনার ভাড়া ১০ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। এক মাস আগে বুকিং দিয়েও কনটেইনার পাওয়া যাচ্ছে না।