নতুন খাতে বড় বিনিয়োগ প্রাণের

আটা, লবণ, সয়াবিন তেল, প্রাণী খাদ্য, ব্রয়লার মুরগি, ডিম ও মুঠোফোনে নতুন করে ১,৬৯০ কোটি টাকা বিনিয়োগে যাচ্ছে এই শিল্পগোষ্ঠী।

গাজীপুরের মুক্তারপুরে ১৮০ বিঘা জমির ওপর কালীগঞ্জ অ্যাগ্রো প্রসেসিং লিমিটেড (কেএপিএল) নামে নতুন শিল্পপার্ক গড়ে তুলছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। সেখানে তারা সয়াবিন বীজ প্রক্রিয়াজাত ও ভোজ্যতেল পরিশোধন করবে। এ ছাড়া আটা, লবণ, ডাল, স্টার্চ (কাসাভা থেকে উৎপাদিত, যা বস্ত্রকলে ব্যবহৃত হয়) ও বিভিন্ন ধরনের প্রাণী খাদ্য উৎপাদনের কারখানাও করছে গ্রুপটি।

কেএপিএলে বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্য, কারখানার কাঁচামাল ও প্রাণী খাদ্য উৎপাদনে দেড় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। তার বাইরে মুঠোফোন ও পোলট্রি খাতের ব্যবসাতেও যুক্ত হচ্ছে তারা। পাশাপাশি জুতা ও গ্লাসের বিদ্যমান কারখানা সম্প্রসারণেও বিনিয়োগ করছে এই শিল্পগোষ্ঠী। চলতি বছরের বিভিন্ন সময় নতুন এসব কারখানার উৎপাদন শুরু ও সম্প্রসারণের কাজ শেষ হবে।

সব মিলিয়ে এ বছর করোনার মধ্যে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিনিয়োগ দাঁড়াবে ১ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। তাতে নতুন করে কর্মসংস্থান হবে ২০ হাজার মানুষের। বর্তমানে দেশের শীর্ষস্থানীয় এই শিল্পগোষ্ঠীর রয়েছে ১ লাখ ২৯ হাজার কর্মী। বছর শেষে সেটি দেড় লাখে পৌঁছাবে—এমনটাই প্রত্যাশা প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের কর্মকর্তাদের।

নতুন এই বিনিয়োগ নিয়ে গত ৩০ ডিসেম্বর প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান খান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘করোনার মধ্যে গত বছর নতুন কয়েকটি দেশে পণ্য রপ্তানি করেছি। রপ্তানির তালিকায় নতুন পণ্য যুক্ত হয়েছে। গত বছর যে বীজ বপন করেছি, সেটির ফল চলতি বছর পাব। আগামী দিনে দেশে কৃষিপণ্যের ব্যাপক চাহিদা বাড়বে। সে কারণে আমরা নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছি।’

আহসান খান চৌধুরী আরও বলেন, ‘ঢাকা ও এর আশপাশে নতুন করে কোনো কারখানা করব না। প্রত্যন্ত এলাকায় কারখানা স্থাপন করে স্থানীয় লোকজনের কর্মসংস্থান করব। ঢাকার জন্য যতটুকু দরকার, শুধু ততটুকুর জন্য ঢাকা বা এর পাশে কারখানায় করব। আমাদের ইচ্ছা, চলতি বছর ৩০ হাজার নতুন কর্মী নিয়োগ করব। সেটি না পারলে ২০ হাজার তো করবই।’

প্রত্যন্ত এলাকায় কারখানা করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে গ্রুপটি। এরই অংশ হিসেবে ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা গড়ে তোলা হচ্ছে। ২৫ হাজার বর্গফুট আয়তনের কারখানাটিতে ২০টি উৎপাদন লাইন থাকবে। চলতি বছর উৎপাদনে যাওয়া এই কারখানায় আড়াই হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। কারখানাটিতে টি–শার্ট, পলো শার্ট, অন্তর্বাসসহ বিভিন্ন ধরনের পোশাক তৈরি করা হবে।

প্রযুক্তিপণ্য, বিশেষ করে স্মার্ট ও ফিচার ফোনের পাশাপাশি হেডফোন, ব্যাটারি, চার্জারসহ বিভিন্ন ধরনের মুঠোফোন সরঞ্জাম উৎপাদনে নরসিংদীতে প্রাণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে নতুন একটি ইউনিট চালু করছে এই শিল্পগোষ্ঠী। ১০ কোটি টাকা বিনিয়োগে নতুন এই ইউনিটে মাসে ১ লাখ স্মার্টফোন ও দেড় লাখ ফিচার ফোন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তাদের। ‘প্রোটন’ ব্র্যান্ড নামে এসব স্মার্ট ও ফিচার ফোন বাজারে আসবে আগামী মার্চে।

এর বাইরে পোলট্রি খাতে ৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। মূলত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে তাদের মৎস্য চাষ প্রকল্প এলাকায় ব্রয়লার মুরগি ও ডিম উৎপাদন করা হবে। বছরে ১৫ কোটি ডিম ও ৩৬০ টন মুরগির মাংস সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

এ বিষয়ে আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশে আমিষের দাম অনেক বেশি। বিষয়টি আমাকে কষ্ট দেয়। আমিষের মূল্য কমানোর জন্য আমি মাছ চাষে অনেক বেশি মনোযোগী হয়েছি। পাশাপাশি পোলট্রি খাতে নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছি।’

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ জানায়, নরসিংদীর ডাঙ্গা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে ওয়াকার ফুটওয়্যার কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে ৩৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে এ বছর। বর্তমানে কারখানাটিতে ৬ লাখ জোড়া জুতা উৎপাদিত হয়। নতুন কারখানা হলে উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে হবে ৯ লাখ জোড়া। একই জেলার প্রাণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে গ্লাসের কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা আড়াই গুণ বাড়াতে ৫৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। বর্তমানে মাসে আড়াই লাখ বর্গফুট গ্লাস উৎপাদিত হয়। এরপর তা বেড়ে হবে সাড়ে ৭ লাখ বর্গফুট।

আহসান খান চৌধুরীর বাবা আমজাদ খান চৌধুরী ১৯৮১ সালে ৪২ বছর বয়সে সামরিক বাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ওই বছরই শুরু করেছিলেন ফাউন্ড্রি বা টিউবওয়েল তৈরি ও আবাসন ব্যবসা। সম্বল ছিল পেনশনের টাকা। তবে আবাসন ব্যবসা তিনি বেশি দিন করেননি। ফাউন্ড্রির ব্যবসায় বেশি নজর দেন। রংপুরে ফাউন্ড্রি প্রতিষ্ঠা করেন, নাম দেন রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিটেড (আরএফএল)। কোম্পানিটির আওতায় এখন বহু ধরনের পণ্য রয়েছে। তবে আমজাদ খান চৌধুরীর লক্ষ্য ছিল কৃষি ব্যবসায় নামা। এরই অংশ হিসেবে ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন অ্যাগ্রিকালচারাল মার্কেটিং কোম্পানি লিমিটেড (এএমসিএল)-প্রাণ।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ৪০ বছর পূর্তি হয়েছে গত বছর। আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘চার দশকের যাত্রা ছিল খুবই রোমাঞ্চকর। বর্তমানে আমরা যে জায়গায় পৌঁছেছি, তার ১ হাজার ভাগের ১ ভাগও আমাদের লক্ষ্য ছিল না। বাংলাদেশ যতটুকু দিয়েছে, সেটি স্বপ্নেও ভাবিনি।’