নিট বাড়ছে, ওভেন কমছে

করোনায় ঘরে পরার পোশাকের চাহিদা বেড়েছে। তাতে অর্থবছরের ওভেন পোশাকের রপ্তানি পৌনে ৮ শতাংশ কমলেও নিটের বেড়েছে পৌনে ৫ শতাংশ।

গত জুনে শেষ হওয়া বিদায়ী অর্থবছরে ১ হাজার ৪০৪ কোটি ডলারের ওভেন পোশাকের রপ্তানি হয়েছিল। আর নিট পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩৯০ কোটি ডলারের। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসের ঘটনা পুরো উল্টো। ৪৬৪ কোটি ডলারের ওভেন পোশাকের বিপরীতে নিট পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৫৮০ কোটি ডলারের।

কয়েক বছর ধরে ওভেন ও নিট পোশাকের রপ্তানি কাছাকাছি থাকলেও করোনাভাইরাস হিসাব ওলটপালট করে দিয়েছে। করোনা-পরবর্তী রপ্তানি বাজারে ওভেনকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে নিট। কারণ কী? পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, করোনা সংক্রমণের প্রথম ঢেউয়ের সময় দেশে দেশে লকডাউন জারি করা হয়। স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত, ভ্রমণ বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে ঘরের বাইরে পরার পোশাকের চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে যায়। বিক্রি না থাকায় বিদেশি ক্রেতারাও ক্রয়াদেশ কমিয়ে দেন। অন্যদিকে ঘরে পরার নিট পোশাকের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানিও বাড়তে থাকে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম চার মাস অর্থাৎ জুলাই-অক্টোবরে ৪৬৪ কোটি ডলারের ওভেন পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ কম। আলোচ্য সময়ে ৫৮০ কোটি ডলারের নিট পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি।

প্রশ্ন উঠতে পারে, তাতে সমস্যা কী! রপ্তানি হলেই তো হলো। কিন্তু হিসাবটিকে এতটা সরলীকরণ করার সুযোগ নেই। সাধারণত নিটের তুলনায় ওভেন পোশাকের দাম বেশি। তাই নিটের ক্রয়াদেশ আগের তুলনায় বেশি এলেও তা দিয়ে ওভেনের জায়গা পূরণ সম্ভব না। তাতে সামগ্রিকভাবে পোশাকের রপ্তানি কমবে। অন্যদিকে পর্যাপ্ত ক্রয়াদেশ না এলে ওভেন পোশাককারখানাও বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যদিও নিটের চেয়ে ওভেন পোশাকে মূল্য সংযোজন কম। মানে ওভেন পোশাকের কাঁচামালের একটি বড় অংশ আমদানি করতে হয়। নিটের ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশের বেশি কাপড় দেশীয় কারখানা জোগান দেয়।

ফাইল ছবি

তাহলে ওভেনের চেয়ে নিট পোশাকের রপ্তানি কতটুকু বাড়ল? রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম চার মাস অর্থাৎ জুলাই-অক্টোবরে ৪৬৪ কোটি ডলারের ওভেন পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ কম। আলোচ্য সময়ে ৫৮০ কোটি ডলারের নিট পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি।

ইউরোপ-আমেরিকায় শীত মৌসুমের কারণে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে সাধারণত নিট পোশাকেররপ্তানি কিছুটা বেশি হয়। সেই হিসাবে গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে ওভেনের চেয়ে নিট পোশাকের রপ্তানি ৫০ কোটি ডলার বেশি হয়েছিল। তবে ইপিবির তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছর সেটি দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। গত চার মাসে ওভেনের চেয়ে নিট পোশাকের রপ্তানি ছিল ১১৬ কোটিডলার বেশি।

আচ্ছা এক ফাঁকে বলে নেওয়া যাক, নিট আর ওভেন শ্রেণিতে কোন কোন পোশাক রয়েছে। সাধারণ কথায় গেঞ্জির কাপড়ের তৈরি পোশাকই নিট। যেমন টি-শার্ট, পলো শার্ট, সোয়েটার, ট্রাউজার, জগার, শর্টস প্রভৃতি। অন্যদিকে ফরমাল শার্ট, প্যান্ট, স্যুট, ডেনিম প্রভৃতি ওভেন পোশাক হিসেবে পরিচিত।

করোনার প্রভাবে ক্রয়াদেশ বাতিল ও কারখানা বন্ধ থাকায় গত এপ্রিলে পণ্য রপ্তানিতে ধস নামে। ওই মাসে মাত্র ৫২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। পরের মাসে সেটি বেড়ে হয় ১২৩ কোটি ডলার। জুনে রপ্তানি অনেকটাই ঘুরে দাঁড়ায়। সেই মাসে রপ্তানি হয়েছিল ২২৪ কোটি ডলারের পোশাক। তাতে গত অর্থবছরে ২ হাজার ৭৯৪ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়, যা আগের বছরের চেয়ে ১৮ শতাংশ কম।

এদিকে গত চার মাসে ১ হাজার ৪৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ২০ শতাংশ কম। রপ্তানি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করার মধ্যেই করোনার সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রকে বিপর্যস্ত করছে। এর ফলে নতুন করে লকডাউনের দিকে যাচ্ছে অনেক দেশ। ক্রয়াদেশ স্থগিত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। নতুন ক্রয়াদেশও আসছে কম। তাতে আগামী বসন্ত ও গ্রীষ্মের ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা।

আবার নিট-ওভেন পোশাকের আলোচনায় ফেরা যাক। ইপিবির তথ্যানুযায়ী, গত চার মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) ৪০৮ কোটি ডলারের নিট পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ বেশি। তবে ইইউর চেয়েও যুক্তরাষ্ট্রে নিটের রপ্তানি বেশি বেড়েছে। গত চার মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পেরদেশে ৬৭ কোটি ডলারের নিট পোশাক রপ্তানি হয়, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৮ শতাংশ বেশি। এ ছাড়া কানাডায় নিটের রপ্তানি পৌনে ৭ শতাংশ বেড়েছে।

নিট পোশাক রপ্তানি ভালো হওয়ার দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, ইউরোপের বড় বাজারে আমাদের নিট পোশাকের রপ্তানি বেশি। দ্বিতীয়ত, অনেক ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান করোনাকালে দ্রুত সময়ে নিট পোশাক উৎপাদন করতে বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছে। তাতে নিটের অনেক ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে এসেছে। নিটের পশ্চাৎমুখী শিল্পে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে।
ফজলুল হক , বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি

বিশ্বখ্যাত একটি ব্র্যান্ডের বাংলাদেশের শীর্ষ এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, করোনায় লকডাউনের কারণে স্বাভাবিকভাবেই ঘরে পরার পোশাকের চাহিদা বেড়েছে। ফরমাল শার্ট, প্যান্ট ও ব্লেজারের মতো পোশাক এখন খুব বেশি বিক্রি হচ্ছে না। তিনি বলেন, চীন ও তুরস্ক থেকে নিট পোশাকের প্রচুর ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে আসছে। কারণ বাংলাদেশে কম দামে উৎপাদন করা যাচ্ছে। যদিও নিট পোশাকের বাড়তি ক্রয়াদেশ দিয়েও ওভেনের ঘাটতি মেটানো যাবে না। কারণ, ওভেন পোশাকের দাম বেশি নিট পোশাকের তুলনায়।

জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, নিট পোশাক রপ্তানি ভালো হওয়ার দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, ইউরোপের বড় বাজারে আমাদের নিট পোশাকের রপ্তানি বেশি। দ্বিতীয়ত, অনেক ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান করোনাকালে দ্রুত সময়ে নিট পোশাক উৎপাদন করতে বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছে। তাতে নিটের অনেক ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে এসেছে। নিটের পশ্চাৎমুখী শিল্পে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে।

ফজলুল হক আরও বলেন, করোনায় সব দেশেই ওভেন পোশাকের ক্রয়াদেশ কমেছে। সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলেই ওভেনের রপ্তানি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। অন্যদিকে নিটের ক্রয়াদেশ বৃদ্ধি পাওয়ায় সামনের দিনগুলোতে তা ধরে রাখার একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে।