নেতৃত্বের লড়াইয়ে দ্বিতীয় প্রজন্ম

সংগঠনটির পরিচালনা পর্ষদে আগেও দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যবসায়ীরা এলেও এবার সংখ্যাটি চোখে পড়ার মতো।

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতৃত্বে ধীরে ধীরে দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যবসায়ীরা আসতে শুরু করেছেন। সংগঠনটির পরিচালনা পর্ষদে আগে হাতে গোনা কয়েকজন দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যবসায়ী থাকলেও এবার নতুন করে ১০ জন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যাঁরা উচ্চশিক্ষা শেষে বাবার গড়ে তোলা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হয়েছেন। এ ১০ জনের মধ্যে ৫ জনের বাবা অথবা মা সংগঠনটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।

আগামী ৪ এপ্রিল বিজিএমইএর ২০২১-২৩ মেয়াদের পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে অংশ নিচ্ছে দুই দল বা জোট। সংগঠনের ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৩৫ পরিচালক পদের বিপরীতে সম্মিলিত পরিষদ ও ফোরামের ৭০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সম্মিলিত পরিষদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ফারুক হাসান আর ফোরামের নেতৃত্বে আছেন এ বি এম সামসুদ্দিন।

সম্মিলিত পরিষদের অধীনে দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্য থেকে প্রার্থী হয়েছেন এনভয় গ্রুপের পরিচালক তানভীর আহমেদ ও শেহরিন সালাম, স্টারলিং গ্রুপের পরিচালক ইমরানুর রহমান, বিটপী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মিরান আলী, স্প্যারো গ্রুপের এমডি শোভন ইসলাম, হাবিব গ্রুপের পরিচালক তানভীর হাবিব। তাঁদের মধ্যে মিরান আলী বর্তমানে বিজিএমইএর পরিচালক। প্রথমবারের মতো প্রার্থী হওয়া তানভীর আহমেদের বাবা কুতুবউদ্দিন আহমেদ, শেহরিন সালামের বাবা আবদুস সালাম মুর্শেদী ও ইমরানুর রহমানের বাবা সিদ্দিকুর রহমান। এ তিনজনের বাবাই বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি।

১৯৮৪ সালে কুতুবউদ্দিন আহমেদের হাতে গড়া এনভয় গ্রুপ দেশের পোশাক ও বস্ত্র খাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। পড়াশোনা শেষ করে ২০০৮ সালে গ্রুপের ব্যবসায় যুক্ত হন তানভীর আহমেদ। পাশাপাশি শেল্‌টেক্‌ গ্রুপের এমডি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

তানভীর আহমেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ভাবমূর্তি নেতিবাচক। বিজিএমইএর নির্বাচনে জয়ী হলে আমি ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়তে কাজ করব। এ ছাড়া কারখানার মধ্য ও উচ্চপর্যায়ে বিদেশিদের স্থলাভিষিক্ত করতে দেশীয়দের দক্ষতা, উন্নয়ন ও শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে উদ্যোগ নেব।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মাজহারুল ইসলামের গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান স্প্যারো অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাঁর ছেলে শোভন ইসলাম। তিনি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করে ২০০৭ সালে ব্যবসায় যুক্ত হন। গত ১৩ বছরে বাবার ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা ১ হাজার ৭০০ কোটিতে নিয়ে গেছেন শোভন। দেশের পাশাপাশি জর্ডানে যৌথ মালিকানায় কারখানা করেছেন দ্বিতীয় প্রজন্মের এই ব্যবসায়ী। সেখানে কাজ করেন ১ হাজার ৬০০ বাংলাদেশি শ্রমিক।

শোভন ইসলাম বলেন, ‘ভিয়েতনামসহ অন্যান্য দেশে কমপ্লায়েন্সের বিচারে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির ছোট-মাঝারি কারখানা ঠিকায় (সাবকন্ট্রাকটিং) কাজ করে। অথচ বাংলাদেশে ঠিকায় কাজ করার ক্ষেত্রে নানা রকম বিধিনিষেধ আরোপ করেন ক্রেতারা। আমি বিজিএমইএর পরিচালনা পর্ষদে যুক্ত হতে পারলে ছোট-মাঝারি কারখানার জন্য ব্যবসা সহজ করার বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেব।’

নির্বাচনের আরেক প্যানেল ফোরামের অধীনে দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্য থেকে প্রার্থী হয়েছেন মোহাম্মদী গ্রুপের পরিচালক নাভিদুল হক, ইভিন্স গ্রুপের পরিচালক শাহ রাঈদ চৌধুরী, ট্রাউজার লাইনের এমডি রানা লায়লা হাফিজ, ফ্যাশন ডটকমের এমডি খান মনিরুল আলম, ড্রেসম্যান গার্মেন্টসের পরিচালক মাশেদ রুম্মান আবদুল্লাহ ও দেশ গার্মেন্টসের পরিচালক ভিদিয়া অমৃত খান। ভিদিয়া বিজিএমইএর পর্ষদে আগেই যুক্ত হয়েছেন। অন্যরা প্রথমবারের মতো নির্বাচন করছেন। তাঁদের মধ্যে নাভিদুল হকের বাবা আনিসুল হক বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও মা রুবানা হক সংগঠনের বর্তমান সভাপতি। এ ছাড়া শাহ রাঈদ চৌধুরীর বাবা আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি।

১৯৮৬ সালে মাত্র ৫২ জন শ্রমিক নিয়ে পোশাক কারখানা করেছিলেন প্রয়াত আনিসুল হক। তাঁর হাতে গড়া মোহাম্মদী গ্রুপে ২০০৬ সালে যোগ দেন নাভিদুল হক। তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা করা দ্বিতীয় প্রজন্মের এই ব্যবসায়ী বর্তমানে বিজিএমইএর অনলাইন ইউডি সিস্টেম তৈরি করেছেন।

জানতে চাইলে নাভিদুল হক গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারলে প্রযুক্তি ব্যবহার করে পোশাক খাতকে কীভাবে আরও এগিয়ে নেওয়া যায়, সেই চেষ্টা করব। ইতিমধ্যে আমি অনলাইন ইউডি সিস্টেম তৈরি করেছি, যা পোশাক খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে।’

পড়াশোনা শেষ করে করপোরেট সংস্কৃতি শিখতে লংকা-বাংলায় চাকরি করেন শাহ রাঈদ চৌধুরী। তারপর যোগ দেন ইভিন্স গ্রুপে। গত আট বছরে ভাই ও মাকে নিয়ে নোয়া নামে দেশে পোশাকের ব্র্যান্ড গড়েছেন রাঈদ। ভাইকে সঙ্গে নিয়ে পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা করেছেন। পাশাপাশি জাপানি ব্র্যান্ড মিনিসোর ব্যবসাও সামলাচ্ছেন দ্বিতীয় প্রজন্মের এই ব্যবসায়ী।

শাহ রাঈদ চৌধুরী বলেন, ‘নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে তৈরি পোশাকের ব্যবসা টেকসই করাই আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনে বিজয়ী হলে আমি সেই চ্যালেঞ্জ নিতে চাই।’

নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যবসায়ীদের নিয়ে উভয় প্যানেলের দলনেতাই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। সম্মিলিত পরিষদের ফারুক হাসান বললেন, দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যবসায়ীরাই পোশাক খাতকে অন্য উচ্চতায় নেবেন। ফোরামের দলনেতা এ বি এম সামসুদ্দিন বললেন, দুই বছর ধরে তাঁরা কাজ করছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই পরীক্ষিত।