পাটকল বন্ধ হলে পাটমন্ত্রীর চাকরি কেন থাকবে

সরেজমিন অনুসন্ধান ও গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
ছবি। প্রথম আলো

সরকারি পাটকলে কোটি কোটি টাকা লোকসানের পেছনে কাঁচা পাট কেনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরে অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনাগুলো ছিল বহুল আলোচিত। তার সঙ্গে জড়িত ছিলেন প্রকল্পপ্রধান থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা। তবে পাটকল বন্ধ করা হলেও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা এখনো চাকরিতে বহাল আছেন। মাঝখান থেকে বেকার হয়েছেন ৫০ হাজার শ্রমিক। আবার পাওনা পরিশোধ না করেই হুমকি–ধমকি দিয়ে শ্রমিকদের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে।

সরকারি পাটকল বেসরকারীকরণ করা হলে পাটশিল্পের সম্প্রসারণ ও শ্রমিকের কর্মসংস্থান বাড়বে, এমনটা বলা হলেও যুক্তিটির কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। বিভিন্ন সময় বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া অর্ধেক কারখানাই আর চালানো সম্ভব হয়নি। এসব ক্ষেত্রে সস্তায় জমি ও যন্ত্রপাতি লুট অথবা পরিত্যক্ত জমি দেখিয়ে বিপুল অঙ্কের ব্যাংকঋণ নেওয়া হয়েছে। সরকারি পাটকল বেসরকারীকরণের মাধ্যমে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা রয়েছে।

গত জুলাইয়ে বন্ধ হওয়া সরকারি পাটকল নিয়ে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ বিশ্লেষণমূলক ত্রৈমাসিক সংকলন সর্বজনকথার উদ্যোগে পরিচালিত সরেজমিন অনুসন্ধান ও গবেষণা প্রতিবেদনে এমনটাই উঠে এসেছে। পাশাপাশি বন্ধ হওয়া ছয়টি চিনিকল নিয়েও আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

আরও পড়ুন

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে গতকাল সোমবার আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রতিবেদন দুটি প্রকাশ করা হয়। পাটকল ও চিনিকল নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন যথাক্রমে সর্বজনকথার সহসম্পাদক মাহা মির্জা ও মোশাহিদা সুলতানা। বক্তব্য দেন ত্রৈমাসিকটির প্রকাশক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান ও আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। সঞ্চালনা করেন সর্বজনকথার সম্পাদক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।

মাহা মির্জা বলেন, ‘মাত্র ১০০০ থেকে ১২০০ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করলেই রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের উৎপাদন সক্ষমতা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেত। প্রতি ইউনিটে খরচ অনেক কমে আসত। তবে আমরা দেখলাম, সমস্যাগুলো সমাধানে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। বরং ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার তহবিলের পরিবর্তে পাটকল বন্ধ করে শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দেওয়ার বাজেট হিসেবে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলো। কাজেই এটা পরিষ্কার যে অর্থের সংকট নয়, বরং সদিচ্ছার অভাবই পাটশিল্পের লোকসানের মূল কারণ।’

গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারি পাটকলের লোকসানের অন্যতম কারণ হচ্ছে পাট মন্ত্রণালয় থেকে সঠিক সময়ে কাঁচা পাট কেনায় বরাদ্দ না দেওয়া। বেসরকারি পাটকল মালিকেরা কম দামে পাট কিনে গুদামজাত করে আর বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) মৌসুম চলে গেলে ইচ্ছাকৃতভাবে বেশি দামে নিম্নমানের পাট কেনে। শত শত বেল পাটের ভেতরে বালু ও পানি দিয়ে ওজন বেশি দেখিয়ে দাম ধরার অভিযোগ আছে। যন্ত্রাংশ রক্ষণাবেক্ষণের খরচ দুই থেকে তিন গুণ বেশি দেখানোও লোকসানের কারণ। স্বাধীনতার পর ৪৪ বছর পাটকল লোকসান করলেও নতুন কোনো বিনিয়োগ হয়নি। যন্ত্রপাতি আধুনিকায়নেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অথচ লোকসানের কারণ তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায় শুধু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেই পাটকলগুলো লাভজনক করা সম্ভব ছিল।

আরও পড়ুন

তিন কারণে চিনি উৎপাদনে খরচ বেশি

সরকারি মিলে প্রতি কেজি চিনি বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি খরচে উৎপাদনের জন্য তিনটি কারণ চিহ্নিত করে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, চিনি উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত আখ পাওয়া যায় না। তাই বছরের বড় সময়জুড়ে উৎপাদন বন্ধ থাকে। আবার বেশির ভাগ চিনিকলে বহুমুখী পণ্য উৎপাদনের সুযোগ নেই।

সরকার চিনিকলের আধুনিকায়নে কোনো বিনিয়োগ না করে এবং কৃষকদের প্রণোদনা না দিয়ে করপোরেশনকে ঋণ নিতে বাধ্য করে। এতে করে চিনি উৎপাদনের খরচ দিন দিন বেড়ে যায়। এ ছাড়া খুচরা যন্ত্র ও বিভিন্ন মেরামতকাজ, উপজাত বিক্রি এবং সার, বীজ ও কীটনাশক প্রদানে দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণেও লোকসানে থাকে চিনিকল

মোশাহিদা সুলতানা বলেন, বন্ধ চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীদের চালু থাকা মিলে সমন্বয়ের কথা বলা হচ্ছে। তবে চালু থাকা মিলের শ্রমিক-কর্মচারী ধারণ করার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। শ্রমিক-কর্মচারীরা মনে করেন, কিছু পদ পুনর্বিন্যাস করা হলেও সবাইকে স্থানান্তরিত করা যাবে না। নারী কর্মীরা সবচেয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। তিনি আরও বলেন, কিছু উদ্যোগ নিলেই লোকসান কমিয়ে আনা যায়। কিন্তু লোকসানের প্রকৃত কারণ নিয়ে ততটা আলোচনা হয় না। মূলত সমস্যাগুলোকে কাজে লাগিয়ে চিনিকল বন্ধ করা ও কিছু চেনা গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়ার যৌক্তিকতা তৈরি করা হচ্ছে।

পাটমন্ত্রীর চাকরি কেন থাকবে?

কোটি কোটি টাকা লোকসানের অজুহাতে পাটকল বন্ধ হলে পাটমন্ত্রীর চাকরি কেন থাকবে, সেই প্রশ্ন তোলেন অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, লোকসানি পাটকল বন্ধ করে শ্রমিকদের বেকার করা হয়েছে। পাটকলে লোকসান হলে পাটমন্ত্রীর চাকরি কেন থাকবে। বিজেএমসির কর্মকর্তারা কেন গাড়ি চড়বেন। তাঁদের শাস্তি কেন হবে না।

আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘ব্যবসা করা সরকারের কাজ না—পাটকল বন্ধের পেছনে এমন যুক্তিও দেওয়া হচ্ছে। আমরাও সেটি মনে করি। তবে হাজার হাজার মানুষকে বিপদে ফেলাও তো সরকারের কাজ না। অন্যদিকে চীন, রাশিয়া ও ভারতের সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ব্যবসা করছে। কেবল বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থাই ব্যবসা করলে সমস্যা।’