পাথরের ব্যবসায় বড় গ্রুপ

পাঁচ বছরে আমদানি বেড়েছে প্রায় সাত গুণ। দেশের খনি থেকেও উত্তোলন বেড়েছে। বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প ও সড়ক উন্নয়নে ব্যবহৃত হচ্ছে এসব পাথর।

করোনায় চাহিদা কমায় বহু পণ্যের আমদানি কমেছে। অথচ এ করোনাকালেও পণ্য আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে নির্মাণকাজের উপকরণ পাথরে। শুধু বাড়ছেই না, পাঁচ বছরে পাথর আমদানি প্রায় সাত গুণ বেড়েছে।

মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র ও গভীর সমুদ্রবন্দর, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো বড় বড় প্রকল্পে এখন সবচেয়ে দরকারি পণ্য পাথর। শুধু মেগা প্রকল্পেই এখন পাথরের চাহিদা সীমাবদ্ধ নেই। গ্রামে-গঞ্জে অবকাঠামো উন্নয়নেও পাথরের ব্যবহার বেড়েছে।

পাথরের চাহিদা বাড়লেও এত দিন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ঠিকাদার বা প্রতিষ্ঠানগুলোই পণ্যটি আমদানি করত। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ছোট ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এই ব্যবসায় যুক্ত হতে শুরু করে। আর এখন বাজার বড় হতে থাকায় বড় শিল্প গ্রুপও পাথরের ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে। দুই বছর আগে বসুন্ধরা গ্রুপ শুরু করে পাথর আমদানি। গ্রুপটি গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৫ লাখ ৭০ হাজার টন পাথর আমদানি করেছে।

নিজেদের প্রকল্পে গুণগত মানের পাথর ব্যবহারের জন্যই পণ্যটি আমদানি করছি। অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারখানা স্থাপন ও রেডিমিক্স কারখানায় ব্যবহার করা হচ্ছে এসব পাথর।
মোস্তফা কামাল, চেয়ারম্যান, মেঘনা গ্রুপ

নিজেদের অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নে পাথর আমদানিতে যুক্ত হয়েছে দেশের আরেক বড় শিল্প গ্রুপ মেঘনা। নিজেদের চাহিদা মেটানোর পর অতিরিক্ত পাথর সীমিত পরিসরে বিক্রিও করছে গ্রুপটি। জানতে চাইলে মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিজেদের প্রকল্পে গুণগত মানের পাথর ব্যবহারের জন্যই পণ্যটি আমদানি করছি। অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারখানা স্থাপন ও রেডিমিক্স কারখানায় ব্যবহার করা হচ্ছে এসব পাথর।’

পাথর আমদানিতে শীর্ষে আছে এনডিই গ্রুপ। গত অর্থবছর বন্দর দিয়ে যত পাথর আমদানি হয়েছে, তার এক-চতুর্থাংশ বা ২০ লাখ টনই এনেছে গ্রুপটি। এ ছাড়া নিজেদের নির্মাণকাজের জন্য কেএসআরএম, কনকর্ড, ম্যাক্স গ্রুপসহ অনেক গ্রুপ পাথর আমদানি করছে।

শুরুর দিকে পাথর আমদানিকারক ও প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে এখন বিশ্বমানের স্থাপনা হচ্ছে। দেশে উৎপাদিত রড-সিমেন্টের মান এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। নির্মাণ খাতের আরেক উপকরণ ইটের খোয়া দিয়ে টেকসই স্থাপনা নির্মাণ সম্ভব নয়। এ জন্য পাথর এখন অপরিহার্য পণ্য।

তিন বছর আগেও চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১০ লাখ টন পাথর আমদানি হয়েছিল। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৫০ লাখ টন। বাংলাদেশে চাহিদা বাড়তে থাকায় দুবাই থেকে পাথর রপ্তানিতে যুক্ত হয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরাও।

শীর্ষে আরব আমিরাত

পাঁচ বছর আগপর্যন্ত পাথর আমদানির উৎসস্থল ছিল ভারত ও ভুটান। আমদানি হতো স্থলবন্দর দিয়ে। স্থলবন্দর দিয়ে ট্রাকে করে পাথর এনে চাহিদা সামাল দেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে বিকল্প উৎস হিসেবে বিভিন্ন দেশ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে প্রথম পাথর আমদানি শুরু হয়। বিকল্প উৎসের মধ্যে শুরুতে ভিয়েতনাম ও চীন শীর্ষ স্থানে থাকলেও সে স্থান দখল করে নিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)।

তিন বছর আগেও চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১০ লাখ টন পাথর আমদানি হয়েছিল। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৫০ লাখ টন। বাংলাদেশে চাহিদা বাড়তে থাকায় দুবাই থেকে পাথর রপ্তানিতে যুক্ত হয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরাও।

জানতে চাইলে ভারত, ওমান ও দুবাইভিত্তিক পাথর রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান জেঅ্যান্ডপি এন্টারপ্রাইজের অংশীদার মোহাম্মদ এরশাদ প্রথম আলোকে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের পাথরের গুণগত মান অনেক দেশের চেয়ে ভালো। আবার দুবাইয়ের ফুজাইরা বন্দর থেকে পাথরের কোয়ারি খুব কাছে। ফলে খরচও তুলনামূলক কম। এ কারণে বাংলাদেশে পাথর সরবরাহের শীর্ষে উঠে এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইউএইর শহর দুবাই।

রপ্তানিকারকেরা জানান, পাথর যেখানে উত্তোলিত হয়, সেখানে টনপ্রতি দাম তিন থেকে চার মার্কিন ডলার। এই পাথর কোয়ারি থেকে জাহাজে ওঠানো ও চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত পৌঁছাতে আমদানি মূল্য দাঁড়ায় টনপ্রতি ১৮ থেকে ২১ ডলার। অর্থাৎ পাথরের মূল দামের চেয়ে পরিবহন ও ওঠানো-নামানোর খরচ বেশি।

আমাদের কোম্পানির পাথরের মান খুবই ভালো। চাহিদা বাড়ায় গত অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ, অর্থাৎ ৮ লাখ ৬৫ হাজার টন পাথর বিক্রি হয়েছে। গুণগত মান ভালো হওয়ায় কঠিন শিলার পাথর ব্যবহৃত হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রেল, সড়ক ও মহাসড়ক নির্মাণকাজে।
আবু তালেব ফরাজী , মহাব্যবস্থাপক, মধ্যপাড়া কঠিন শিলা কোম্পানি

খনিতে উত্তোলন বেড়েছে

দেশে একটিমাত্র খনি থেকে পাথর উত্তোলিত হয়। পেট্রোবাংলার অধীন দিনাজপুরের পার্বতীপুরে মধ্যপাড়া কঠিন শিলা কোম্পানিতে ২০০৭ সাল থেকে পাথর উত্তোলন শুরু হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি পাথর উত্তোলনের রেকর্ড হয়েছে এ খনিতে। গত তিন বছরে গড়ে ৯ লাখ টনের কাছাকাছি পাথর উত্তোলিত হয়েছে খনিটি থেকে। অবশ্য খনি থেকে যত পাথর উত্তোলিত হয়, তা দেশের চাহিদার মাত্র ৫ শতাংশ।

খনি কর্মকর্তারা জানান, একসময় এই খনির পাথর অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে থাকলেও এখন বিক্রি বেড়েছে। মজুত এক লাখ টনে নেমে এসেছে। প্রতিদিন পাঁচ হাজার টনের মতো পাথর উত্তোলিত হচ্ছে খনি থেকে।

জানতে চাইলে মধ্যপাড়া কঠিন শিলা কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক আবু তালেব ফরাজী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কোম্পানির পাথরের মান খুবই ভালো। চাহিদা বাড়ায় গত অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ, অর্থাৎ ৮ লাখ ৬৫ হাজার টন পাথর বিক্রি হয়েছে। গুণগত মান ভালো হওয়ায় কঠিন শিলার পাথর ব্যবহৃত হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রেল, সড়ক ও মহাসড়ক নির্মাণকাজে।’ তিনি আরও বলেন, সরকার যে বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তাতে পাথরের প্রচুর চাহিদা তৈরি হয়েছে। আগামী এক দশকজুড়ে পাথরের চাহিদা বাড়বে।

দেশে এখন ভাঙা পাথরই আমদানি হচ্ছে বেশি। নদীশাসনের কাজে মাতারবাড়ী প্রকল্পে এখন বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ টন বোল্ডার পাথর আমদানি হচ্ছে।

শীর্ষ আমদানি পণ্যের পথে পাথর

এক দশকের বেশি সময় ধরে একক পণ্য হিসেবে আমদানির পরিমাণের দিক থেকে তালিকায় শীর্ষ স্থানে রয়েছে সিমেন্টশিল্পের কাঁচামাল ক্লিংকার। গত অর্থবছর দেশে ক্লিংকার আমদানি হয় ১ কোটি ৮৭ লাখ টন। পাথর আমদানির পরিমাণ এর চেয়ে মাত্র সাত লাখ টন কম। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরেই তা ছাড়িয়ে যাবে বলে আমদানিকারকদের ধারণা।

আমদানির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে এখন ভাঙা পাথরই আমদানি হচ্ছে বেশি। নদীশাসনের কাজে মাতারবাড়ী প্রকল্পে এখন বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ টন বোল্ডার পাথর আমদানি হচ্ছে।

৫ বছর আগে পাথরের বাজারের আকার ছিল ৬০ কোটি টাকার। এরপর প্রতিবছর এই বাজারের আকার বেড়েছে। এই বাজার এখন ছয় হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানান, করোনা পরিস্থিতি সামলে নেওয়া গেলে বছরে পাথরের চাহিদা দাঁড়াবে তিন কোটি টনে। এর সঙ্গে বাড়বে বাজারের আকারও।