পিককের খপ্পরে ২৯ কারখানা

২৯ পোশাক কারখানা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। পাওনা আদায়ে ব্যান্ডটির আগের মালিকপক্ষকে ই-মেইল দিয়েছেন বিজিএমইএর সভাপতি।
পিককের খপ্পরে ২৯ কারখানা

যুক্তরাজ্যের ব্র্যান্ড পিককের ক্রয়াদেশ পেয়ে সোয়েটার প্রস্তুত করে টঙ্গীর বোর্ডবাজারের এমটি সোয়েটারস। গত সেপ্টেম্বরে সাড়ে পাঁচ লাখ ডলারের সোয়েটার রপ্তানি করে তারা। দীর্ঘ ছয় মাস বিদেশের বন্দরে পড়ে থাকার পর গত মাসে পিকক কর্তৃপক্ষ সেই পোশাক খালাস করেছে। এই ক্রেতার জন্য প্রস্তুত ও আধা তৈরি করা আরও সাড়ে পাঁচ লাখ ডলারের পোশাক এখন এমটি সোয়েটারসের গুদামে পড়ে আছে।

দীর্ঘদিন ধরে সাড়ে ৫ লাখ ডলার বা প্রায় ৪ কোটি ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা না পেয়ে বিপদে আছে এমটি সোয়েটার। এই প্রতিষ্ঠানের মতোই বাংলাদেশের আরও ২৮টি পোশাক কারখানা পিককের খপ্পরে পড়েছে। তারা লাখ লাখ ডলারের পোশাক প্রস্তুত করে এখন আর্থিক ক্ষতির মুখে আছে। এরই মধ্যে পিককের মালিকানা বদল হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা কিনে নিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট কনসোর্টিয়াম।

এমটি সোয়েটারসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাড়ে পাঁচ লাখ ডলারের সোয়েটার আমার কারখানায় পড়ে আছে। সেই পোশাক কবে নেবে, আদৌ নেবে কি না, সে বিষয়ে কিছুই বলছে না পিকক।’
যুক্তরাজ্যের এই ব্র্যান্ডের জন্য পোশাক তৈরি করে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া কারখানামালিকেরা বলছেন, করোনা শুরুর পর গত বছর আইনকানুন না মেনেই বিপুলসংখ্যক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করে পিকক। প্রস্তুত পণ্য বিদেশের বন্দরে পড়ে থাকলেও সেগুলোর দাম শোধ করেনি তারা। মালিকানা বদলের পর পুরোনো ক্রয়াদেশের পণ্যে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ মূল্যছাড় দাবি করছে পিকক।

৭৪ বছরের পুরোনা ইডব্লিউএম গ্রুপের মালিকানায় আছে পিকক, কান্ট্রি ক্যাজুয়াল, অস্টিন রেডসহ পোশাকের বেশ কিছু ব্র্যান্ড। করোনার প্রথম ধাক্কায় গত বছর বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়ে গ্রুপটি। প্রথমে পিককের মালিকানা বিক্রির চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণার উদ্যোগ নেয়। পরে আইনিভাবে দায়দেনা মুক্ত হয়ে ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট কনসোর্টিয়ামের কাছে ব্র্যান্ডটি বিক্রি করে দেয় ইডব্লিউএম। পেছন থেকে এটির নেতৃত্বে আছেন ইডব্লিউএমের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা স্টিভ সিমসন, যে কারণে পিককের মালিকানায় অনানুষ্ঠানিকভাবে ইডব্লিউএমই রয়েছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা।

এদিকে নতুন মালিকানায় পিককের বিক্রয়কেন্দ্র গত মাসে খুলতে শুরু করেছে। নতুন মালিকপক্ষ পিককের ২ হাজার কর্মী ও ২০০ বিক্রয়কেন্দ্রের দায়িত্ব নিয়েছে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্র্যান্ডটির বাকি ২০০ বিক্রয়কেন্দ্র পিকক নামে খোলার সম্ভাবনা নেই।

পিককের জন্য ৪৩ হাজার ৫০০টি ডেনিম প্যান্ট তৈরি করে বিপদে আছে ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড। সব মিলিয়ে যুক্তরাজ্যের ব্র্যান্ডটির কাছে ডেনিম এক্সপার্টের পাওনা ২ লাখ ডলার বা ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

ইডব্লিউএম বা পিককের কারণে কতগুলো কারখানা কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে, তা জানতে উদ্যোগ নেয় তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। ২১ এপ্রিল এক নোটিশের মাধ্যমে নিজেদের সদস্যদের তিন দিনের মধ্যে যুক্তরাজ্যের এই ব্র্যান্ডের কাছে পাওনা অর্থের বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে বলে সংগঠনটি। কিছু তথ্য পাওয়ার পর ১১ মে বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বাংলাদেশি কারখানামালিকদের পাওনা অর্থ পরিশোধের জন্য তাগাদা দিয়ে ইডব্লিউএম গ্রুপের চেয়ারম্যান জন হেরিংকে ই-মেইল পাঠান। পরদিনই ফিরতি মেইলে জন হেরিং লেখেন, পিককের বর্তমান মালিকানায় ইডব্লিউএমের কোনো অংশীদারত্ব নেই। তিনি (জন হেরিং) সরাসরি বর্তমান মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দেন।

পিককের জন্য ৪৩ হাজার ৫০০টি ডেনিম প্যান্ট তৈরি করে বিপদে আছে ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড। সব মিলিয়ে যুক্তরাজ্যের ব্র্যান্ডটির কাছে ডেনিম এক্সপার্টের পাওনা ২ লাখ ডলার বা ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

জানতে চাইলে ডেনিম এক্সপার্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘ঈদের আগে যুক্তরাজ্যের একটি ফ্যাশন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানতে পারি ইডব্লিউএম গ্রুপের চেয়ারম্যান বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের পাওনা পরিশোধে আশ্বাস দিয়েছেন। তারপর আমার কারখানার গুদামে থাকা পণ্যের বিষয়ে জানতে পিককের বর্তমান কর্তৃপক্ষকে মেইল করি। কিন্তু সব কটি মেইলই ফেরত আসে।’

আমাদের উদ্যোক্তাদের পাওনা অর্থ পেতে আমরা প্রথমে পিককের সঙ্গে আলোচনা করব। উভয় পক্ষই যেন লাভবান হয়, সেই চেষ্টা করা হবে। চেষ্টা ব্যর্থ হলে পিককের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশন আইন অনুযায়ী মামলা করা হবে।
ফারুক হাসান, সভাপতি, বিজিএমইএ

অবশ্য পিককের কিংবা তার মূল মালিক ইডব্লিউএম নিয়ে আলোচনা এবারই প্রথম নয়। গত বছরও করোনার শুরুর দিকে ইডব্লিউএম বাংলাদেশের রিভার সাইড সোয়েটার, স্কাই লাইন অ্যাপারেলস, সাউদার্ন ডিজাইনারসসহ কয়েকটি কারখানার ১১ লাখ ৯৫ হাজারটি পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল করে। ওই পোশাকের রপ্তানি মূল্য ৮২ লাখ ডলারের বেশি। পোশাকের দাম পরিশোধে বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও কোনো সদুত্তর না পাওয়ায় কারখানামালিকেরা বিজিএমইএ ও বিকেএমইএতে অভিযোগ করেন। তখন অর্থ পরিশোধে নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়ে সংগঠন দুটির সভাপতি যৌথভাবে ইডব্লিউএমের প্রধান নির্বাহী ফিলিপ অ্যাডওয়ার্ড ডেকে ই-মেইল করেন, পাওনা পরিশোধ না করলে কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। এই হুমকির পরও কোনো সুরাহা হয়নি।

বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের উদ্যোক্তাদের পাওনা অর্থ পেতে আমরা প্রথমে পিককের সঙ্গে আলোচনা করব। উভয় পক্ষই যেন লাভবান হয়, সেই চেষ্টা করা হবে। চেষ্টা ব্যর্থ হলে পিককের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশন আইন অনুযায়ী মামলা করা হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।’