পিপিপি নয়, আগ্রহ ইজারায়

ফাইল ছবি

বন্ধ হওয়া সরকারি পাটকলগুলো সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) চালু করার পরিকল্পনা থাকলেও সেটি হচ্ছে না। কারণ, ব্যবসায়ীরা পিপিপিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তাঁরা পাটকল দীর্ঘমেয়াদি ইজারা বা লিজ চান। সেই সঙ্গে পাটকলের পুরোনো দায়দেনাও নিতে রাজি নন ব্যবসায়ীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বন্ধ পাটকল পিপিপি নাকি ইজারা দিয়ে চালু করা হবে, সে বিষয়ে মন্ত্রণালয় কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। তবে বিষয়টি নিয়ে আগামীকাল বৃহস্পতিবার বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সভাপতিত্বে একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। শেষ পর্যন্ত সরকারের উচ্চপর্যায়ে থেকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে।

বেসরকারি পাটকল লাভের মুখ দেখলেও বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) পাটকলগুলো বছরের পর বছর লোকসান গুনছিল। লোকসানের বোঝা বইতে না পেরে ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী শ্রমিককে স্বেচ্ছা–অবসরে (গোল্ডেন হ্যান্ডশেক) পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করে ১ জুলাই পাটকল বন্ধ করে দেয় সরকার। শ্রমিকদের পর বিজেএমসির কর্মকর্তা-কর্মচারী কমানোর চিন্তাভাবনাও চলছে।

বিজেএমসির আওতায় গত জুনে ২৬টি পাটকলের মধ্যে চালু ছিল ২৫টি। এগুলোর মধ্যে ২২টি পাটকল ও ৩টি নন–জুট কারখানা। পাটকলগুলোর মধ্যে ঢাকা অঞ্চলে ৭টি, চট্টগ্রামে ১০টি ও খুলনা অঞ্চলে ৯টি রয়েছে। বন্ধ করার সময় বলা হয়েছিল, পিপিপির ভিত্তিতে যত দ্রুত সম্ভব পাটকলগুলো চালু করা হবে।

বন্ধ পাটকল চালু ও বিজেএমসির অন্যান্য সম্পত্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীকে প্রধান করে নীতিনির্ধারণী কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৫ আগস্ট সেই কমিটির সভায় পাটকলের যন্ত্রপাতি, স্থাপনা ইত্যাদি সম্পর্কে বাস্তব ধারণা দেওয়ার জন্য আগ্রহী ব্যবসায়ীদের পাটকল পরিদর্শনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ২০ আগস্ট পর্যন্ত পাটকলগুলো পরিদর্শন করেন অনেক ব্যবসায়ী। তাঁদের মধ্যে পাট খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন ব্যবসায়ীও আছেন।

জানতে চাইলে বিজেএমসির চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রউফ গত সপ্তাহে প্রথম আলোকে বলেন, সব কটি পাটকলই বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী পরিদর্শন করে দেখেছেন। তবে তাঁরা পিপিপিতে পাটকল চালাতে রাজি নন। তাঁরা চান ইজারা। ফলে পাটকল চালু করতে নতুন করে চিন্তাভাবনা হতে পারে মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সরকারি পাটকল চালুর বিষয়ে বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) কাছে প্রস্তাব চেয়েছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১০ আগস্ট বিজেএমএর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারী এফবিসিসিআইকে জানান, পাটকল ৯৯ বছরের ইজারা দেওয়া হলে বেসরকারি উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মিলের কার্যক্রম পুনরায় চালু করতে পারবেন। স্বল্পমেয়াদি ইজারা দেওয়া হলে ব্যাংকের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ বহুমুখী পাটপণ্য প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি রাশেদুল পিপিপিতে পাটকল চালানোর অভিজ্ঞতা কারও নেই। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিয়েও সংশয় আছে। তাই উদ্যোক্তারা ইজারায় পাটকল নিতে আগ্রহী।

১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ রাষ্ট্রপতির এক আদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন, পরিত্যক্ত ও সাবেক ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের ৭৮টি পাটকল নিয়ে বিজেএমসি গঠিত হয়। ১৯৮১ সালে মিলের সংখ্যা বেড়ে হয় ৮২টি। তৎকালীন স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকার ৩৫টি পাটকল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেন। ৮টি পাটকলের পুঁজি প্রত্যাহার করা হয়। পরবর্তীকালে বিশ্বব্যাংকের পাট খাত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় ১১টি পাটকল বন্ধ, বিক্রি ও একীভূত করা হয়। ২০০২ সালের জুনে বন্ধ হয় আদমজী জুট মিল।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, বেসরকারীকরণের অংশ হিসেবে যেসব সরকারি পাটকল অতীতে হস্তান্তর করা হয়েছে, সেগুলো রাজনৈতিক প্রভাবে পাট খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, এমন ব্যবসায়ীর হাতেও গেছে। তাঁদের অনেকে শিল্পের চরিত্র বদলে ফেলেছেন। তাতে পাটকল বেসরকারীকরণের উদ্দেশ্য অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছে।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, আদমজী জুট মিল বন্ধ হওয়ার আগে সেখানে ২২ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। পাটকলটি বন্ধ হওয়ার পর রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল বা ইপিজেড করা হয়েছে। সেখান থেকে সাড়ে চার শ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। কর্মসংস্থান হয়েছে ৬২ হাজার মানুষের। তাই বন্ধ পাটকলগুলোকে বেজা বা বেপজার কাছে হস্তান্তর করে পাটসহ অন্যান্য খাতের উদ্যোক্তাদের বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার।