ফেরত দিতেই টেলিটকের ব্যয় এত কমল

সেবার মান বাড়িয়ে চতুর্থ প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবা ফোর-জি নেটওয়ার্ক গ্রাম পর্যন্ত প্রসারিত করতে ৩ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ের একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মানায় সেই প্রকল্পের ব্যয় এখন ১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা কমতে যাচ্ছে। এতে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণ অর্থ অপচয় থেকে বেঁচে যাবে।  

ঘটনার সূত্রপাত চলতি বছরের শুরুর দিকে। গত ২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ‘গ্রাম পর্যায়ে টেলিটকের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক আধুনিকায়ন’ শিরোনামে একটি প্রকল্প উত্থাপন করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা। প্রকল্পটির আওতায় নতুন করে দেড় হাজার টাওয়ার (বিটিএস) স্থাপন এবং আরও দেড় হাজার টাওয়ার শেয়ারিংয়ের প্রস্তাব করে টেলিটক।

ওই সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চান, প্রকল্পটি একনেক সভায় উত্থাপনের আগে কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল কি না? মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, করা হয়নি। তখন প্রধানমন্ত্রী তৃতীয় পক্ষ দিয়ে বিস্তারিতভাবে প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নির্দেশনা দেন। একই সঙ্গে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের জন্য নতুন টাওয়ার না বসিয়ে টাওয়ার শেয়ারিংয়ের কথা বলেন।

এত বড় একটি প্রকল্প তখন আমরা কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই একনেক সভায় তুলেছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আমরা সমীক্ষা করে পুনরায় প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছি।
মোস্তাফা জব্বার, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী

জানতে চাইলে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার গত সোমবার রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত বড় একটি প্রকল্প তখন আমরা কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই একনেক সভায় তুলেছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আমরা সমীক্ষা করে পুনরায় প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছি।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে এস এম আহমেদ অ্যান্ড কোম্পানিকে দিয়ে প্রকল্পটি বিস্তারিতভাবে যাচাই-বাছাই করে টেলিটক। এতে দেখা যায়, প্রকল্পের ব্যয় ৩ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা থেকে কমে এক লাফে ১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা কমছে। এবারে প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ২ হাজার ২০৪ কোটি টাকা। নিজস্ব উদ্যোগে টেলিটক নতুন টাওয়ার স্থাপন করবে ৫০০, যা আগের প্রস্তাবে ছিল দেড় হাজার। তবে টাওয়ার শেয়ারিংয়ের সংখ্যা দেড় হাজার থেকে বাড়িয়ে আড়াই হাজার করা হচ্ছে।

পক্ষান্তরে টাওয়ার কোম্পানিগুলো বলছে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান টেলিটক নিজেরা টাওয়ার স্থাপন করতে পারে না। কারণ, সরকারই চারটি কোম্পানিকে টাওয়ার শেয়ারিং বা মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার অবকাঠামো ভাগাভাগি-সংক্রান্ত লাইসেন্স দিয়েছে। এই চারটি কোম্পানির বাইরে অন্য কারও টাওয়ার স্থাপন করার সুযোগ নেই।

সামিট টাওয়ার লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আরিফ আল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান টেলিটক নিজেরা কখনো টাওয়ার স্থাপন করতে পারে না। তাদের আইনগত সেই বৈধতা নেই। বিটিআরসি চারটি কোম্পানিকে টাওয়ার বসানোর দায়িত্ব দিয়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান টেলিটক নিজেরা কখনো টাওয়ার স্থাপন করতে পারে না। তাদের আইনগত সেই বৈধতা নেই। বিটিআরসি চারটি কোম্পানিকে টাওয়ার বসানোর দায়িত্ব দিয়েছে।
আরিফ আল ইসলাম, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), সামিট টাওয়ার লিমিটেড

মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, যদি টাওয়ার কোম্পানি দেশের কোথাও টাওয়ার স্থাপনে রাজি না হয়, তখন অবশ্যই টেলিটক টাওয়ার স্থাপন করতে পারবে। তিনি বলেন, ‘টাওয়ার কোম্পানিগুলো নিজেদের ব্যবসা আগে দেখে। তারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে টাওয়ার স্থাপন করতে আগ্রহী নয়। আমাদের জনগণের কথা মাথায় রাখতে হয়। ব্যবসা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। যেসব জায়গায় টাওয়ার কোম্পানি যেতে আগ্রহী হয় না, বিশেষ করে পার্বত্য জেলা, হাওর-বাঁওড়সহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমরা নতুন করে ৫০০ টাওয়ার বসানোর প্রস্তাব করেছি।’

সামিট টাওয়ারের সিইও আরিফ আল ইসলাম বলেন, ‘দেশের যেকোনো প্রান্তেই হোক না কেন, আমরা অবশ্যই টাওয়ার নির্মাণ করব। কেন আমরা টাওয়ার স্থাপন করব না। এটাই তো আমাদের কাজ।’ তিনি বলেন, ‘সরকার আমাদের টাওয়ার বসাতে বলেছে কিন্তু আমরা তা বাস্তবায়ন করিনি, এমন কোনো উদাহরণ কি সরকার দেখাতে পারবে? যদি সরকার দরপত্র আহ্বান করত, স্থান বলে দিত, তালিকা দিত, কিন্তু আমরা অংশগ্রহণ না করতাম, তখন বলা যেত। কিন্তু আমাদের কিছু না বলে যদি বলা হয় তারা ব্যবসা দেখে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে চায় না—এ কথা যৌক্তিক নয়। আমরা দেশের যেকোনো অঞ্চলেই যেতে রাজি।’

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) যে চার কোম্পানিকে টাওয়ার স্থাপনের লাইসেন্স দিয়েছে, এর বাইরে টেলিটক টাওয়ার স্থাপন করতে পারে কি না, তা নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনও প্রশ্ন তুলেছে। যদিও টেলিটকের দাবি, বিটিআরসি থেকে তাদের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি।

আরও পড়ুন

সরকার দুই বছর আগে চারটি কোম্পানিকে টাওয়ার শেয়ারিং তথা মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার অবকাঠামো ভাগাভাগি-সংক্রান্ত লাইসেন্স দেয়। সামিট ছাড়া বাকি ৩ কোম্পানি হচ্ছে ইডটকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিডেট, কীর্তনখোলা টাওয়ার বাংলাদেশ লিমিটেড এবং এবি হাইটেক কনসোর্টিয়াম লিমিটেড।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে টেলিটকের ভয়েস ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের কাভারেজ অন্য মোবাইল ফোন অপারেটরদের তুলনায় বেশ সীমিত। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট সুবিধা খুবই কম। বর্তমানে টেলিটকের টাওয়ারের সংখ্যা ৫ হাজার ২০০। এই টাওয়ার অন্য প্রতিযোগী মোবাইল অপারেটরগুলোর তুলনায় কম।

এমন বাস্তবতায় টেলিটকের ফোর-জি নেটওয়ার্ক গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতেই প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। এটি বাস্তবায়িত হলে টেলিটকের নেটওয়ার্ক সেবার গুণগত মান যেমন বাড়বে, তেমনি ইন্টারনেট সেবাও প্রসারিত হবে।

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের অতিরিক্ত সচিব অঞ্জন কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, এক বছর আগে এই প্রকল্প একনেকে উত্থাপন করা হলেও তখন অনুমোদন না দিয়ে বেশ কিছু বিষয় সংশোধন করতে বলা হয়েছিল। সংশোধন করে প্রকল্পটি ফের পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি নিয়ে শিগগিরই আন্তমন্ত্রণালয় সভা হওয়ার কথা রয়েছে।

সেবার মান নিয়ে অভিযোগ, অসন্তোষ

এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটকের সেবা নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগের অন্ত নেই। সংস্থাটির সেবার মান যে সন্তোষজনক নয়, তা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে।

এতে বলা হয়েছে, টেলিটকের নেওয়া প্রকল্পগুলো থেকে সুফল মিলছে না। থ্রি-জি প্রযুক্তি চালুকরণ ও ২.৫ জি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ নামের একটি প্রকল্প সরেজমিন পরিদর্শন শেষে আইএমইডি যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, টেলিটকের ইন্টারনেট সুবিধা ভালো নয়। নেটওয়ার্ক মাঝেমধ্যে খুব খারাপ থাকে।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টেলিটকের ইন্টারনেট প্যাকেজ সুবিধা কম। সব জায়গায় থ্রি-জি নেটওয়ার্ক সার্ভিস নেই। শহরের মধ্যে যা কিছুটা নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়, শহরের বাইরে কাভারেজ পাওয়া যায় না। টেলিটকের সেবার মান সন্তোষজনক নয়। এই প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক কাভারেজ অন্য অপারেটরদের চেয়ে অনেক কম। তা ছাড়া প্রয়োজনের তুলনায় টাওয়ার বিটিএসের সংখ্যা কম হওয়ায় গ্রাম পর্যায়ে নেটওয়ার্কের খুব সমস্যা থাকে।