বিনিয়োগ করেও শান্তিতে নেই তারা

কানাডাভিত্তিক কোম্পানি গিল্ডান অ্যাকটিভ ওয়্যার ঢাকার সাভারে অবস্থিত তাদের পোশাক কারখানায় বিদ্যুৎ ও গ্যাস-সংযোগ পাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। বিষয়টি তারা বাংলাদেশে কানাডীয় হাইকমিশনকে জানিয়েছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) বিনিয়োগ-উত্তর সেবা শাখায়ও গিল্ডানের অভিযোগ জমা পড়ে। বিডার সহযোগিতায় অবশেষে গত মাসে কারখানায় বিদ্যুৎ ও গ্যাস-সংযোগ পেয়েছে গিল্ডান।

বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে এসে এভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির মতো পরিষেবা পেতে পদে পদে হয়রানি হতে হচ্ছে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে। বাদ পড়ছে না দেশীয় কোম্পানিগুলোও। সে জন্য বিডার ‘আফটার কেয়ার’ বা বিনিয়োগ-উত্তর সেবা শাখায় প্রতিদিন দেশি-বিদেশি কোম্পানি মিলিয়ে চার-পাঁচটি করে অভিযোগ জমা পড়ছে। পরিষেবা প্রদানে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দীর্ঘসূত্রতা বিনিয়োগকারীদের দুশ্চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। সেবা পেতে দেরি হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের খরচ বাড়ছে।

বিডার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিনিয়োগকারীরা সঠিক সময়ে লাইসেন্স না পাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। তাঁরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা লাইসেন্স দিতে গড়িমসি করেন। তখন টাকার লেনদেনে দফারফা করতে হয়। গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ পেতেও হয়রান হতে হয়। এ দেশে করপোরেট করহার বেশি বলেও অভিযোগ অনেক বিনিয়োগকারীর। জমির নামজারি ও ব্যাংকঋণ পেতে দেরি হওয়ার পাশাপাশি বন্দরে শুল্ক নিয়ে জটিলতার মুখে পড়তে হয় বলেও অনেক অভিযোগ জমা পড়ে। আবার নতুন বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, তাঁদের অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়তে হয়। তবে সব বিনিয়োগকারীরই একটি সাধারণ অভিযোগ হলো, প্রকল্প এলাকায় তাঁদের ‘স্থানীয় নোংরা রাজনীতির মুখে পড়তে হয়’।

চীনের বহুজাতিক কোম্পানি ভিভো মুঠোফোনের অভিযোগ, ‘নিয়ম মেনে স্থানীয় এক ব্যক্তির ডিলারশিপ বাতিল করায় তিনি মামলা ঠুকে দিয়েছেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তিকে দিয়ে ক্রমাগত হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন।’ এ বিষয়ে ভিভোকে সংশ্লিষ্ট থানায় জিডি করার পরামর্শ দিয়েছে বিডা।

ওয়েল ডেভ নামে একটি সফটওয়্যার কোম্পানি অভিযোগ করেছে, বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করতে গিয়ে বন্দরে তারা হয়রানির শিকার হচ্ছে। তারা বিষয়টির সুরাহা চেয়েছে বিডার কাছে। এডিসন মার্সন, লাফার্জ হোলসিমসহ বেশ কয়েকটি বিদেশি কোম্পানি অভিযোগ জমা দিয়েছে বিডাতে। তাদের অভিযোগ, স্থানীয় রাজনীতির কারণে তাদের ব্যবসা ব্যাহত হচ্ছে।

নিয়ম অনুযায়ী দেশি-বিদেশি কোনো উদ্যোক্তা বিনিয়োগ করতে চাইলে প্রথমে বিডাতে গিয়ে কোম্পানির নিবন্ধন করতে হয়। আগে নিবন্ধন দেওয়ার মধ্য দিয়েই দায়িত্ব শেষ করত সংস্থাটি। ২০২০ সালে বিডা বিনিয়োগ-উত্তর সেবা নামে একটি শাখা চালু করে। বিনিয়োগ করার পর কোম্পানিগুলো কী ধরনের সমস্যায় পড়ে, তা জানতেই শাখাটি চালু করা হয়, যাতে সমস্যাগুলোর সমাধান করা যায়। বিডার কর্মকর্তারা জানান, ইতিমধ্যে বেশ কিছু সমস্যার সমাধান হয়েছে। অনেকগুলো সমস্যা সমাধানের পথে রয়েছে। অবশ্য বিডার এ শাখা সম্পর্কে এখনো অনেক ব্যবসায়ী অবগত নন। করোনা মহামারির কারণে শাখাটি নিয়ে তেমন প্রচারও হয়নি। পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক হলে নতুন শাখা খোলা ও সমাধান দেওয়ার বিষয়ে বিডা প্রচার চালাবে জানান সংস্থাটির কর্মকর্তারা।

সরকারি দপ্তরগুলোর সেবা নিতে গিয়ে তাদের সমস্যা হচ্ছে বেশি। আমরা সেসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। সরকারি দপ্তরগুলোর আন্তরিকতা থাকলে এসব সমস্যা থাকত না।
সিরাজুল ইসলাম, নির্বাহী চেয়ারম্যান, বিডা

জানতে চাইলে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কাছ থেকে নিবন্ধন নেওয়ার পর উদ্যোক্তাদের নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। বিশেষ করে সরকারি দপ্তরগুলোর সেবা নিতে গিয়ে তাদের সমস্যা হচ্ছে বেশি। আমরা সেসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। সরকারি দপ্তরগুলোর আন্তরিকতা থাকলে এসব সমস্যা থাকত না।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিনিয়োগ-উত্তর সেবা নিয়ে আমাদের প্রচার কম হয়েছে। এ বিষয়ে সবাইকে জানাতে শিগগিরই প্রচার শুরু করা হবে।’

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাম্প্রতিক এক জরিপেও উঠে এসেছে, দেশে ব্যবসা করতে গিয়ে দুর্নীতিকেই প্রধান বাধা হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসার ক্ষেত্রে ১৬টি সমস্যার মধ্যে দুর্নীতিকে এক নম্বরে রেখেছেন তাঁরা। তাঁদের মতে, প্রশাসনিক অদক্ষতা ও অর্থায়নের সীমিত সুযোগ হলো তৃতীয় সমস্যা। এর আগে ২০২০ সালেও ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে একটি জরিপ করেছিল সিপিডি। তখনো একই সমস্যা উঠে এসেছিল।

বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলসের (বিএসআরএম) বিডাতে একটি আবেদন করেছে। তাদের বক্তব্য হলো, ফেনী নদী থেকে পাইপলাইনে পানি আনতে সরকারি দুটি দপ্তরের জমি ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেও পাওয়া যায়নি। যে কারণে তাদের ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। তাই সরকারি দুই দপ্তরের জমি ব্যবহারের ব্যবস্থা করে দিতে বিডাতে আবেদন জানায় বিএসআরএম। অবশেষে বিডার হস্তক্ষেপে ফেনী নদী থেকে পাইপলাইনে পানি আনতে সরকারের ওই দুটি দপ্তরের জমি ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে কোম্পানিটি।

বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) তপন সেনগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফেনী নদী থেকে পানি আনার বিষয়ে বিডা আমাদের সহযোগিতা করেছে। ফেনী নদী থেকে পানি আনার পাইপলাইন বসানোর জন্য সরকারের দুটি দপ্তর থেকে অনুমতি পেয়েছি আমরা। পাম্প হাউস স্থাপনে জমি লিজও পেয়েছি। এখন শিগগিরই কাজ শুরু করব আমরা।’

৩৮ কোম্পানির অভিযোগ শুনল বিডা

এদিকে বিডার বিনিয়োগ-উত্তর সেবা শাখা থেকে ৩৮টি দেশি-বিদেশি কোম্পানিকে আলাদাভাবে ডেকে তাদের সমস্যার কথাও শোনা হয়েছে। এসব কোম্পানি যে পরিমাণ বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা কেন করেনি, বৈঠকে সেটিও বিডা জানতে চেয়েছে। সেখানেও এসব কোম্পানি একই ধরনের সমস্যার কথা বলেছে। কোম্পানিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো ব্রাইট অ্যান্ড ইকো লিমিটেড, জেনারেল ইকো টেক লিমিটেড, ভারগো গ্যাস লিমিটেড, এলপি এম লিমিটেড, সিঙ্গার বাংলাদেশ প্রভৃতি।