ব্যাংক চায় এফবিসিসিআই

প্রায় সব ব্যাংকের মালিকই ব্যবসায়ী। তারপরও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই নতুন করে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

আইনশৃঙ্খলা, সশস্ত্র ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর তিনটি ছাড়া বেসরকারি খাতের প্রায় সব ব্যাংকের মালিকই ব্যবসায়ী। সেই ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এখন নতুন করে আবার ব্যাংক করতে চায়। নিজেদের সদস্যদের এতগুলো ব্যাংক থাকার পরও এবং বাণিজ্য সংগঠন হিসেবে কেন এফবিসিসিআইয়ের ব্যাংক ব্যবসায় নামার প্রয়োজন দেখা দিল, সেটি নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠেছে। সমালোচনা শুরু হয়েছে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও।

অবশ্য শুধু ব্যাংক নয়, বিমা, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালও করতে চায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই)। গতকাল রোববার অনলাইনে অনুষ্ঠিত সংগঠনটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় এসব বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার আগেই সরকারের উচ্চমহলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় এফবিসিসিআইয়ের শীর্ষ নেতৃত্বের। সেখান থেকে ইতিবাচক বার্তা পাওয়ার পরই পর্ষদ সভায় অনুমোদনের জন্য তা প্রস্তাব আকারে তোলা হয়।

ব্যাংক পাওয়া এখন রাজনীতি ও স্বজনপ্রীতির অংশ হয়ে গেছে। অর্থনীতির চাহিদা বিবেচনায় নতুন কোনো ব্যাংকের প্রয়োজন নেই।
মইনুল ইসলাম, সাবেক অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এ বিষয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম প্রথম আলোকে বলেন, আজকের (গতকাল) পর্ষদ সভায় এফবিসিসিআইয়ের নিজস্ব ব্যাংক, বিমা, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল করার বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার হবেন। ব্যাংকটি থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের উদ্যোক্তারা অল্প খরচে ও সহজে ঋণ পাবেন। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে ও প্রযুক্তির সহযোগিতা নিয়ে পরিচালনা করা হবে এই ব্যাংক। এতে ঋণ বিতরণের খরচও কমবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শেখ ফজলে ফাহিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পর্ষদ সভার শুরুতে গত দুই বছরের বিভিন্ন কার্যক্রমের তথ্য তুলে ধরা হয়। তিন ঘণ্টার বৈঠকের শেষ দিকে এফবিসিসিআইয়ের নিজস্ব ব্যাংক, বিমা, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে প্রস্তাব দেন সভাপতি। পরিচালনা পর্ষদের বেশ কয়েকজন সদস্য প্রস্তাবের পক্ষে মত দেন। তবে ভিন্নমতও ছিল। বিষয়টিকে আগামী পর্ষদের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন একজন পরিচালক।

জানতে চাইলে এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক সংস্থারই তো ব্যাংক আছে। ব্যবসায়ী সংগঠনের নেই। এফবিসিসিআই ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন, তাদের একটা ব্যাংক থাকতেই পারে। এই ধারণা থেকেই একটি ভার্চ্যুয়াল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব তোলা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ব্যাংকের বোর্ডে কারা থাকবেন, সেটি সংগঠনের সাবেক সভাপতিরা বসে ঠিক করবেন।

এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের মেয়াদ শেষের দিকে। আগামী মাসেই নতুন পর্ষদ দায়িত্ব নিতে পারেন। ইতিমধ্যে ভোট ছাড়াই নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। সবকিছু ঠিক থাকলে সংগঠনটির সভাপতি পদে বসতে যাচ্ছেন বেঙ্গল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ভাইস চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন। তিনি বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান।

বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি ৬১টি ব্যাংক চালু আছে। এর মধ্যে ৪৩টি ব্যাংকের মালিক ব্যবসায়ীরা। এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি ছিলেন এমন ব্যবসায়ীদের মধ্যে সালমান এফ রহমান বর্তমানে আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান, কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এ কে আজাদ শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক, মীর নাসির হোসেন ইস্টার্ণ ব্যাংকের পরিচালক এবং আবদুল আউয়াল মিন্টু ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান। এ ছাড়া ব্যবসায়ী নেতাদের অনেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যাংক পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। ফলে এফবিসিসিআইয়ের মালিকানাধীন নতুন ব্যাংকের ভূমিকা কী হবে, সেটা নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে অর্থনীতি ও দেশের আকার বিবেচনায় যত ব্যাংক দরকার ছিল এরই মধ্যে তার চেয়ে বেশি ব্যাংক হয়ে গেছে। দেশে যাদের ক্ষমতা আছে, তারাই এখন ব্যাংকের মালিক। ব্যাংক পাওয়া এখন রাজনীতি ও স্বজনপ্রীতির অংশ হয়ে গেছে। অর্থনীতির চাহিদা বিবেচনায় নতুন কোনো ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। তবে এফবিসিসিআই ব্যাংক পেয়ে গেলে আমি অবাক হব না। কারণ, এফবিসিসিআই কারা চালায়, এটা সবাই জানে।’

আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে ২০১২ সালে ৯টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়। সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকেও নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া নিয়ে দ্বিমত ছিল। অর্থনীতিবিদেরাও এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তারপরও অনুমোদন পাওয়া সব ব্যাংকই পান সরকার-সমর্থিত ব্যক্তিরা। এরপর একে একে অনুমোদন দেওয়া হয় সীমান্ত ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ও সিটিজেন ব্যাংক। এ ছাড়া পিপলস ব্যাংকের চূড়ান্ত অনুমোদনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। সব ব্যাংকই অনুমোদন পাচ্ছে সরকারের বিশেষ নির্দেশে।

অবশ্য ব্যাংক-বিমা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে এফবিসিসিআইয়ের ভেতরেই দ্বিমত আছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পরিচালক বলেন, ব্যবসা করা এফবিসিসিআইয়ের কাজ নয়। ব্যাংক-বিমার ব্যবসায় নামলে এফবিসিসিআইয়ের মূল কাজ ব্যাহত হবে। ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে ব্যাংক-বিমা চালানো গেলেও সেখানে পদ পাওয়ার জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হতে পারে।