ভরা মৌসুমে মাথায় হাত

করোনা সংক্রমণ রোধে সরকারের বিধিনিষেধের কারণে ঈদের ব্যবসা মার খাচ্ছে। এবার সুযোগ না পেলে অনেক ব্যবসায়ী নিঃস্ব হয়ে যাবেন।

ছবি: আনিস মাহমুদ

সপ্তাহখানেক পরই শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস, এর পরেই ঈদুল ফিতর। বড় এই উৎসবকে ঘিরেই দেশের পোশাকের ব্যবসা চাঙা হয়। সে জন্য রোজা শুরুর মাসখানেক আগে থেকেই ব্যবসা জমতে শুরু করে পাইকারি বাজারে। গতবার করোনার কারণে ছন্দপতন হলেও চলতি বছর ভালো ব্যবসার আশা করছিলেন পাইকারেরা। তবে আবার সংক্রমণ বাড়তে থাকায় সরকারি বিধিনিষেধের কারণে দোকানপাট বন্ধ। এতে বড় ধরনের লোকসানের আশঙ্কা করছেন পাইকারেরা।

দেশের ভেতর তৈরি পোশাকের বড় তিন পাইকারি বাজার ইসলামপুর, বাবুরহাট ও কেরানীগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনার কারণে গতবার কোনো ব্যবসা হয়নি। সেই লোকসান পোষাতে এবার ব্যবসায়ীরা বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেন। এ অবস্থায় রোজার আগে দোকান খুলতে না পারলে অনেকেই আর ব্যবসায় টিকতে পারবেন না। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে হলেও দোকানপাট খোলার দাবি ব্যবসায়ীদের।

দেশের অন্যতম বড় পাইকারি বাজার পুরান ঢাকার ইসলামপুর। মোগল আমলে বাংলার সুবেদার ইসলাম খাঁ চিশতির নামানুসারে এই এলাকার নামকরণ হয়েছিল ইসলামপুর। ১৭৭৩ সাল থেকে এখানে কাপড়ের পাইকারি ব্যবসা শুরু হয়। তার আগে ইসলামপুরে ফলের ব্যবসা ছিল। সময়ের ব্যবধানে ইসলামপুরের কাপড়ের ব্যবসা সদরঘাটসহ আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে এখানে বিক্রমপুর গার্ডেন সিটি, গুলশান আরা সিটি, সাউথ প্লাজা, জাহাঙ্গীর টাওয়ার, চায়না মার্কেটসহ ছোট-বড় মিলিয়ে মার্কেটের সংখ্যা ১৪২। সেসব মার্কেটে দোকানের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি।

ক্ষতি পোষাতে এবার ব্যবসায়ীরা বিপুল বিনিয়োগ করেছিলেন। এবারও অনিশ্চয়তার মুখে পড়লেন সবাই। দ্রুত দোকানপাট খুলে না দিলে অনেক ব্যবসায়ী পথে বসবেন।
নেসার উদ্দিন মোল্লা, সাধারণ সম্পাদক, ইসলামপুর বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতি

দেশি-বিদেশি থান কাপড় থেকে শুরু করে থ্রিপিস, শাড়ি, লুঙ্গি, বাচ্চাদের পোশাক, বিছানার চাদর, পর্দার কাপড় ইত্যাদি পাওয়া যায় ইসলামপুরে। তা ছাড়া কাপড় তৈরির সব ধরনের সরঞ্জামও পাওয়া যায়। সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও ব্যবসায়ী নেতারা জানান, বছরে ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয় ইসলামপুরে, যার ৫০ শতাংশের কাছাকাছি হয় রোজার মাসে।

ইসলামপুরের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস দুই থেকে তিন মাস আগে থেকেই থান কাপড় কিনছে। অন্যদিকে প্রস্তুত করা পোশাক গত মাস থেকে কিনতে আসছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা। তবে রোজার দুই সপ্তাহ আগে থেকে বেচাবিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি। সেটি কেবল শুরু হয়েছিল। তখনই সরকার করোনা সংক্রমণে বিধিনিষেধ দেয়।

ইসলামপুর বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নেসার উদ্দিন মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের আগে মূল ব্যবসাটা হয় এ সময়ে। করোনার কারণে গতবারের ঈদে কোনো ব্যবসা হয়নি। সেই ক্ষতি পোষাতে এবার ব্যবসায়ীরা বিপুল বিনিয়োগ করেছিলেন। এবারও অনিশ্চয়তার মুখে পড়লেন সবাই। দ্রুত দোকানপাট খুলে না দিলে অনেক ব্যবসায়ী পথে বসবেন।

ইসলামপুরের মতোই নরসিংদীর বাবুরহাটের পাইকারি ব্যবসায়ীদেরও মাথায় হাত। ঈদের ব্যবসা ধরতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেও লোকসান গুনছেন প্রত্যেকে। কেউ কেউ সরকারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে খোলার চেষ্টা করলেও ক্রেতা পাচ্ছেন না। কারণ, দূরপাল্লার গাড়ি বন্ধ থাকায় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ক্রেতারা আসছেন না।

নরসিংদী সদর উপজেলার শেখেরচর-বাবুরহাটে শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রিপিস, শার্ট পিচ, প্যান্ট পিচ, থান কাপড়, পাঞ্জাবির কাপড়, গামছা, বিছানার চাদরসহ প্রায় সব ধরনের দেশীয় কাপড় বিক্রির ছোট-বড় প্রায় ১০ হাজার দোকান রয়েছে। এই বাবুরহাটকে কেন্দ্র করে নরসিংদীজুড়ে গড়ে উঠেছে সহস্রাধিক টেক্সটাইল, ডায়িং, এমব্রয়ডারিসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানা। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ।

বাবুরহাট বণিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সারা বছর আমরা রোজার আগের ব্যবসার জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকি। নতুন পণ্য বিক্রি আর গত মৌসুমের বকেয়া অর্থ উত্তোলন করি। শুরুটাও ভালো হয়েছিল। তবে নতুন বিধিনিষেধে সব শেষ।’

এদিকে কেরানীগঞ্জের পোশাকপল্লিতে ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা জমতে শুরু করেছিল। গত শুক্র ও শনিবার গভীর রাত পর্যন্ত অনেক পাইকারি ব্যবসায়ী পোশাক বিক্রি করেছেন। তবে সরকারি বিধিনিষেধের কারণে সোমবার থেকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের পূর্ব আগানগর, আগানগর ছোট মসজিদ রোড, চর কালীগঞ্জ ও খেজুরবাগ এলাকায় গড়ে ওঠা এই পোশাকপল্লিতে সুনসান নীরবতা।

কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ও দোকান মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি মো. স্বাধীন শেখ বলেন, ‘নতুন করে বিধিনিষেধের সময়সীমা বাড়ালে ব্যবসায়ীরা বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন। আমাদের পাইকারি বাজারে ১৫-২০ রোজা পর্যন্ত ব্যবসা হয়। তারপর ক্রেতাদের ভিড় থাকে না।’