১৪ বছরের আগে কাজ করা যাবে না

ন্যূনতম বয়স-সম্পর্কিত আইএলও কনভেনশন ১৩৮-এ অনুস্বাক্ষর করতে যাচ্ছে সরকার।

দেশে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ হয় কক্সবাজার জেলা সদর ও মহেশখালী উপজেলায়। সেখানে যে ১৫ হাজার শ্রমিক কাজ করেন, তার মধ্যে ২০ শতাংশই শিশু। শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করার কাজটিকে শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে। অথচ সরকার ঘোষিত ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮টি খাতের মধ্যে শুঁটকি নেই। সে জন্য এই কাজে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে জবাবদিহি ছাড়াই পার পেয়ে যান দায়ী ব্যক্তিরা। এমন বাস্তবতায় শুঁটকিসহ আরও পাঁচটি খাতকে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে চায় সরকার ও শ্রমিকপক্ষ। তবে প্রস্তাবিত তালিকা নিয়ে আপত্তি আছে মালিকপক্ষের।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে যে ছয়টি নতুন খাত চিহ্নিত করেছে, সেগুলো হচ্ছে গৃহকর্ম, শুঁটকি, পথশিশু, ইট-পাথর বহন, টেইলারিং বা দরজির কাজ এবং বর্জ্য সংগ্রহ ও তা পোড়ানো। তালিকা সংশোধিত হলে এই ছয় কাজেও শিশুদের সম্পৃক্ত করা যাবে না। এসব কাজ ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় অন্তর্ভুক্তির আগে গত সোমবার ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদের (টিসিসি) বৈঠকে তোলা হয়। এতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ মালিক ও শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকায় নতুন ছয়টি খাতের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে মালিকপক্ষ। তাদের বক্তব্য হলো, পূর্বঘোষিত ৩৮টি খাতের মধ্যে ৫টিতে এখন আর কোনো শিশু শ্রমিক নেই। সেই পাঁচ খাত তালিকা থেকে বাদ দিয়ে তারপর নতুন ছয় খাত অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। মালিকপক্ষ আরও বলেছে, শ্রম আইনে এখন গৃহকর্মী খাতটি নেই। যে খাতটি আইনে নেই, সেটি কেন তালিকায় ঢুকবে? তা ছাড়া পথশিশুদের দায়িত্বভার কার হাতে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে মালিকপক্ষ।

অন্যদিকে বৈঠকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং শ্রমিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পাঁচটি খাতে এখন কোনো শিশুশ্রম নেই, এর মানে এই নয় যে এসব খাতে আবার শিশুশ্রম ফিরে আসবে না। ফিরে এলে তখন আবার এসব খাত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অন্যদিকে শিগগিরই শ্রম আইন সংশোধন করে তাতে গৃহকর্মী খাত ঢোকানো হচ্ছে বলে জানান সরকারি কর্মকর্তারা।

শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নতুন ছয়টি খাত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন। তিনি পথশিশু ও গৃহকর্মীর কাজকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ আখ্যায়িত করে বলেন, ‘যে ছয়টি নতুন খাত তালিকায় ঢোকানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, তার সঙ্গে আমরা পুরোপুরি একমত। এতে শিশু শ্রমিকদের প্রত্যক্ষ লাভ না হলেও পরোক্ষভাবে রাষ্ট্র ঘোষণা দিল যে এসব খাত ঝুঁকিপূর্ণ। এতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে জবাবদিহির আওতায় আনা সহজ হবে। দায়বদ্ধতা তৈরি হবে।’

এদিকে বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) মহাসচিব ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এখন শিশুশ্রম না থাকা পাঁচ খাত আগে তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। যেসব খাতে শিশুশ্রম নেই, সেটাকে কি স্বীকৃতি দেওয়া সরকারের উচিত নয়? এসব খাত তো ভালো করছে। সেই স্বীকৃতি দিতে হবে। তারপর নতুন ছয়টি খাত যোগ করতে হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, দেশে এখন সাড়ে ৩৪ লাখ শিশু শ্রমিক আছে। এদের মধ্যে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশুই ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। জাতিসংঘ ঘোষিত ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ৮ নম্বর লক্ষ্য হচ্ছে শিশুশ্রম নিরসন। সে অনুযায়ী আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসনের প্রতিশ্রুতি রয়েছে সরকারের। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে যে শিশুশ্রম পুরোপুরি নিরসন সম্ভব নয়, এটি সরকারের নীতিনির্ধারকেরাও মানছেন।

প্রসঙ্গ আইএলও কনভেনশন

এদিকে গত সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত টিসিসির ৬৮তম সভায় সরকার, মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষ একমত হয়েছে যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নির্ধারণ করে দেওয়া ন্যূনতম বয়স-সম্পর্কিত ১৩৮ কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করবে সরকার। কারণ, তাতে কাজের জন্য ন্যূনতম বয়স ১৫ বছরের চেয়ে কম না হওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে কোনো দেশে অর্থনৈতিক ও শিক্ষার সুযোগ পর্যাপ্ত না থাকলে তা ১৪ বছর ন্যূনতম বয়স ধরা যেতে পারে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হুমায়ুন কবীর বলেন, বৈঠকে সবাই আইএলওর ১৩৮ কনভেনশন অনুস্বাক্ষর করার বিষয়ে একমত হয়েছেন। এখন এটির ওপর আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং নেওয়া হবে। তারপর মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন হবে। তিনি বলেন, সংশোধিত শ্রম আইনে কাজে যোগদানের ন্যূনতম বয়স ১৪ বছর করা হবে।