২০ বছরের ইজারা দেবে সরকার

সরকারি পাটকল বন্ধের পর সাত মাস চলে গেছে। পাটকল চালু হয়নি। চাকরি হারানো শ্রমিকেরা ক্ষতিপূরণের পুরোটা পাননি। এদিকে বন্ধ পাটকল চালু করতে সরকার যে নীতি নিয়েছে, তাতে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ না–ও দেখাতে পারেন, এমনটা বলছেন পাট খাতের উদ্যোক্তারা।

বন্ধ হওয়ার আগে সরকারি পাটকল
ছবি; সাদ্দাম হোসেন

বন্ধ হওয়া ২৫টি পাটকল পুনরায় চালু করতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ১৫-২০ বছরের জন্য ভাড়ায় ইজারা দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। শুরুতে পরীক্ষামূলকভাবে ৫-৭টি পাটকল ইজারা দেওয়া হতে পারে। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে ৯ সদস্যের একটি আন্তমন্ত্রণালয় ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করেছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে সাত মাস চলে গেছে। পাটকল চালু হয়নি। চাকরি হারানো শ্রমিকেরা ক্ষতিপূরণের পুরোটা পাননি।

এদিকে বন্ধ পাটকল চালু করতে সরকার যে নীতি নিয়েছে, তাতে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ না–ও দেখাতে পারেন, এমনটা বলছেন পাট খাতের উদ্যোক্তারা। তাঁদের বক্তব্য, মধ্যমেয়াদি ইজারা নিয়ে ৪০০-৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চাইবেন না ব্যবসায়ীরা। কারণ, যেকোনো সময় সরকারের নীতি পরিবর্তন হলে ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

প্রাথমিকভাবে পাটকল ১৫-২০ বছরের ইজারায় বেসরকারি উদ্যোক্তাদের দেওয়া হবে। উদ্যোক্তাদের পারফরম্যান্স ভালো হলে ইজারার মেয়াদ বাড়ানো হবে। শুরুতে ৫টি পাটকল চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।
মো. আবদুর রউফ, চেয়ারম্যান, বিজেএমসি

বেসরকারি পাটকল লাভের মুখ দেখলেও বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) পাটকলগুলো বছরের পর বছর লোকসান গুনছিল। লোকসানের বোঝা বইতে না পেরে ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী শ্রমিককে স্বেচ্ছা অবসরে (গোল্ডেন হ্যান্ডশেক) পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করে ১ জুলাই পাটকল বন্ধ করে দেয় সরকার। বিজেএমসির আওতায় গত জুন পর্যন্ত ২৬টি পাটকলের মধ্যে চালু ছিল ২৫টি। এর মধ্যে ২২টি পাটকল ও ৩টি নন জুট কারখানা। ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত পাঁচ অর্থবছরে বিজেএমসির এই পাটকলগুলোর লোকসানের পরিমাণ ২ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা। আর পুঞ্জীভূত লোকসান ১০ হাজার কোটি টাকা।

বন্ধ পাটকল চালু ও বিজেএমসির অন্যান্য সম্পত্তির যথাযথ ব্যবহারের নিশ্চিতের জন্য পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীকে প্রধান করে নীতিনির্ধারণী কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি একাধিক বৈঠক করে একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পাঠায়। সেখান থেকে নির্দেশনা পাওয়ার পর গত মঙ্গলবার পাট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মোহাম্মদ আবুল কালামকে আহ্বায়ক করে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। আন্তমন্ত্রণালয় ওয়ার্কিং কমিটি নামের এই কমিটি বন্ধ পাটকল ভাড়াভিত্তিক ইজারা পদ্ধতিতে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পুনরায় চালু করার বিষয়ে কাজ করবে।

বন্ধ হওয়ার আগে প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিল।
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

জানতে চাইলে বিজেএমসির চেয়ারম্যান মো. আবদুর রউফ প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিকভাবে পাটকল ১৫-২০ বছরের ইজারায় বেসরকারি উদ্যোক্তাদের দেওয়া হবে। উদ্যোক্তাদের পারফরম্যান্স ভালো হলে ইজারার মেয়াদ বাড়ানো হবে। শুরুতে ৫টি পাটকল চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাট খাতের বাইরের কোনো উদ্যোক্তাকে পাটকলগুলো ইজারা দেওয়া হবে কি না, সেটি চূড়ান্ত হয়নি।

শুরুতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) বন্ধ পাটকল চালুর পরিকল্পনা করেছিল বিজেএমসি। বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীকে পাটকল পরিদর্শনের সুযোগও করে দেয় করপোরেশন। তাঁরা পিপিপিতে পাটকল চালাতে রাজি নন। ব্যবসায়ীরা চান, দীর্ঘমেয়াদি ইজারা। শেষ পর্যন্ত মধ্যমেয়াদি ইজারা দেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারি প্রথম আলোকে বলেন, মালিকানা না দিয়ে শুধু ১৫-২০ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হলে বেসরকারি পাট খাতের উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করবেন না। কারণ, পাটকলের যন্ত্রপাতি আধুনিকায়নের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে, যা অল্প সময়ের ইজারায় উঠে আসবে না। বর্তমানে পাটপণ্যে এত মুনাফা নেই। আবার দীর্ঘমেয়াদি ইজারা বা মালিকানা না থাকলে ব্যাংকঋণও পাবেন না উদ্যোক্তারা।

১৫-২০ বছরের ইজারা পেলেও জমি বন্ধক দিয়ে ঋণ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না। কারণ, অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়।
মোহাম্মদ আবুল কালাম, আহ্বায়ক, আন্তমন্ত্রণালয় ওয়ার্কিং কমিটি

সরকারের পাটকলগুলো ১৯৪৯ থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন যেসব যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছিল, তা দিয়েই চালানো হচ্ছিল। এ কারণে উৎপাদনশীলতা অর্ধেকে নামে। ২০০৯ সালে পাটকল লাভজনক করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও যন্ত্রপাতি আধুনিকায়নে নজর দেওয়া হয়নি। তাতে এক টন পণ্য উৎপাদনে বেসরকারি মিলে যেখানে ২৫-২৮ জন শ্রমিক লাগে, সেখানে সরকারি মিলে প্রয়োজন হতো ৬৫-৭০ জন।

জানতে চাইলে আন্তমন্ত্রণালয় ওয়ার্কিং কমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ১৫-২০ বছরের ইজারা পেলেও জমি বন্ধক দিয়ে ঋণ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না। কারণ, অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। এ ব্যবস্থায় ইজারা নিতে উদ্যোক্তারা আগ্রহী হবেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের বিশ্বাস বিনিয়োগ আসবে। কারণ, প্রতিটি পাটকলের অবস্থান ভালো জায়গায়।’