ডলার-সংকট
ঠেকানো যাচ্ছে না রিজার্ভের পতন
বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও রিজার্ভ কমেই চলেছে। অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত আশঙ্কাজনক পর্যায়ে নেমেছে।
দুই বছর আগে দেশে শুরু হওয়া ডলারের সংকট কাটছে না। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়াতে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো রিজার্ভ বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। ডলারের সংকট না কাটায় রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না; বরং প্রায় প্রতিনিয়তই কমছে রিজার্ভ। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) মার্চ ও এপ্রিল মাসের দায় মেটানোর পর বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে মোট রিজার্ভ কমে ২৩ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৩৭৭ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী রিজার্ভ এখন ১৮ দশমিক ৩২ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৮৩২ কোটি ডলার। তবে প্রকৃত বা দায়হীন রিজার্ভ এখন ১৩ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের কিছুটা কম বলে জানা গেছে। প্রকৃত রিজার্ভ সেটাই, যার বিপরীতে কোনো দায় নেই এবং যেকোনো সময় তা ব্যবহার করা যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এখন আমদানি নিয়ন্ত্রণের পরও প্রতি মাসে আমদানি দায় মেটানোর জন্য গড়ে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার প্রয়োজন হচ্ছে। ফলে প্রকৃত রিজার্ভের অর্থ দিয়ে তিন মাসেরও আমদানি খরচ মেটানো যাবে না।
অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত আশঙ্কাজনক পর্যায়ে নেমেছে। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দেশের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার জন্য ভালো পরিমাণ রিজার্ভ থাকা জরুরি। এখন রিজার্ভ যে পর্যায়ে নেমে এসেছে, তা নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কার কারণ আছে। কারণ, এই রিজার্ভ দিয়ে দেশের তিন মাসেরও আমদানি দায় মেটানো যাবে না। ভারতের ১২-১৩ মাস ও ভিয়েতনামের ৭-৮ মাসের আমদানি দায় মেটানোর মতো রিজার্ভ আছে।
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে দেশের কাঙ্ক্ষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব না। উৎপাদন বাড়িয়ে ভালো জিডিপি অর্জন করতে যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি বাড়াতে হবে। এ জন্য আমদানি ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে হবে।
রিজার্ভ কমল কীভাবে
জানা গেছে, গত সপ্তাহে আকু (এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন) বিল বাবদ রিজার্ভ থেকে ১৬৩ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়। ফলে রিজার্ভ আরও কমে যায়।
আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া নিট বা প্রকৃত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ১১ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের অনুরোধের পর আইএমএফ এ লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১ হাজার ৪৭৫ কোটি ডলারে নামিয়েছে। তবে প্রকৃত এই রিজার্ভ এখন ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের কম। ফলে এখনো লক্ষ্য অর্জনের বেশ দূরে রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত মজুত।
২০২১ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের মোট রিজার্ভ ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবেই যা এখন কমে হয়েছে ২ হাজার ৩৭৭ কোটি ডলার। ফলে আড়াই বছরে রিজার্ভ কমে অর্ধেক হয়েছে।
ডলারের দাম একসময় নির্ধারণ করত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ব্যাংক খাত–সংশ্লিষ্ট দুটি প্রতিষ্ঠানকে বিনিময় হার নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার পর ডলারের দাম নির্ধারণে এবার ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ডলারের দাম ক্রলিং বা ওঠানামা করার সুযোগ রাখেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, চলতি মাসের প্রথম ১২ দিনে ৯০ কোটি ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। ক্রলিং পেগ চালু করে ডলারের দাম বাড়িয়ে ১১৭ টাকা করা হয়েছে, এ বাস্তবতায় প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়বে বলে আশা করছেন কর্মকর্তারা। এ ছাড়া ডলারের দাম বাড়ায় রপ্তানি আয় আসাও বাড়বে বলে কর্মকর্তারা মনে করেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন সরকারি আমদানি দায় মেটানোর জন্য প্রতি ডলার ১১৭ টাকা ৪৪ পয়সা দরে বিক্রি করছে। আবার যেসব ব্যাংক বেশি দামে প্রবাসী আয় কিনছে, তাদের ডলার বাংলাদেশ ব্যাংক ১১৭ টাকা ৪৪ পয়সা দরে কিনে নিচ্ছে। এরপরও রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। যে পরিমাণ ডলার বিক্রি করা হচ্ছে, কেনা হচ্ছে তার চেয়ে কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত দুই মাসে ১৬৩ কোটি ডলার আমদানি বিল পরিশোধ করেছে। ফলে রিজার্ভ কিছুটা কমেছে। সামনের মাসে আইএমএফের ঋণের কিস্তি আসবে। এ ছাড়া জুনের মধ্যে বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থছাড় হবে। তিনি আশা করেন, প্রবাসী আয় চলতি মাসে ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। ডলারের প্রবাহ বাড়ার কারণে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির চাপও কমে আসবে।
আর্থিক হিসাবেও বড় ঘাটতি
এদিকে দেশের আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ৯ বিলিয়ন বা ৯০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ প্রান্তিকে ঘাটতির পরিমাণ ৯২৫ কোটি ডলারে উঠেছে। এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ছিল ৪০৯ কোটি ডলার।
একটি দেশের আন্তর্জাতিক সম্পদের মালিকানা হ্রাস-বৃদ্ধির বিষয়টি পরিমাপ করা হয় আর্থিক হিসাবের মাধ্যমে। সাধারণত এই হিসাবে ঘাটতি তৈরি হলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের ওপর চাপ বৃদ্ধি পায়। ডলার-সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় দেড় দশকের মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরুতে প্রথমবারের মতো এ হিসাবে ঘাটতি দেখা দেয়।
বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়াসহ কয়েকটি কারণে ঘাটতি বাড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে। যেমন প্রবাসীরা পুঁজিবাজার বা অন্য খাতে আগের চেয়ে কম বিনিয়োগ করছেন এবং কিছু ক্ষেত্রে বিনিয়োগ উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আবার যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হচ্ছে, তার বিপরীতে দেশে আয় আসা কমেছে।
আর্থিক হিসাবের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই), পোর্টফোলিও বিনিয়োগ, অন্যান্য বিনিয়োগ ও রিজার্ভ অ্যাসেট বিবেচনা করা হয়ে থাকে। অন্যান্য বিনিয়োগের মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক সহায়তা, সরকারের মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, ঋণের কিস্তি পরিশোধ, দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি বাণিজ্যিক ঋণ, ট্রেড ক্রেডিট বা রপ্তানির বিপরীতে প্রত্যাবসিত অর্থ এবং অন্যান্য সম্পদ ও দায়।
ডলারের দামকে পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়ে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, সময়মতো ডলারের দাম বাজারভিত্তিক না করা ও পুরো রপ্তানি আয় দেশে না আসায় সংকট যাচ্ছে না। বাণিজ্যঘাটতি কাটছে না, আর্থিক হিসাবেও ঘাটতি বাড়ছে। ফলে ডলার–সংকট কাটছে না ও রিজার্ভের পতন হচ্ছেই। ডলারের দাম নির্ধারণে যে ধরনের নীতি নেওয়া হয়েছে, তার কোনোটাই টেকসই হচ্ছে না। এখন নতুন পদ্ধতিও বাজারভিত্তিক না। ডলারকে চাহিদা-জোগানের সঙ্গে ওঠানামা করতে দিতে হবে। ব্যাংকগুলোকে প্রতিদিন দামের ঘোষণা দিতে হবে, এতে গ্রাহকেরা পরিষ্কার ধারণা পাবেন। ডলার–সংকট নিরসনে একটি পথনকশা করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা মেনে সংকট নিরসন হবে।
নতুন পদ্ধতি কাজে দেবে কি
ডলার-সংকটের মধ্যে আর্থিক হিসাব ও চলতি হিসাবে ঘাটতি হওয়ায় ২০২২ সালের জুলাইয়ে আইএমএফের কাছে ঋণ চায় বাংলাদেশ। ছয় মাস পর সংস্থাটি গত বছরের ৩০ জানুয়ারি ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করে। এর তিন দিনের মাথায় ২ ফেব্রুয়ারি ঋণের প্রথম কিস্তিতে ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার ও গত ডিসেম্বর মাসে দ্বিতীয় কিস্তিতে ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। ঋণের তৃতীয় কিস্তি বাবদ ১১৫ কোটি ডলার আগামী মাসে আসবে বলে কথা রয়েছে।
আইএমএফের ঋণের শর্ত মেনে গত সপ্তাহে ডলারের মধ্যবর্তী দাম ১১৭ টাকা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক; আগে যা ছিল ১১০ টাকা। ঋণের সুদহারও বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। তবে এসব পদক্ষেপের পরও সংকট কাটবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান অর্থনীতিবিদেরা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের দামের যে পদ্ধতি চালু হয়েছে, তাকে ক্রলিং পেগ বলা হলেও তা ক্রল (ওঠানামা) করছে না। এখন কঠিন সময়ে সঠিক নীতিমালা নিয়ে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। ডলারের দাম যেন ধীরে ধীরে বাড়তে ও কমতে পারে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বিমুখী আচরণ করার সুযোগ শেষ হয়ে এসেছে। পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের সুদহারও পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করার সুযোগ দিতে হবে। তাহলে রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে।