কেন বেড়েই চলেছে অলিভ অয়েলের দাম

পশ্চিমা পৃথিবীতে অলিভ অয়েল বা জলপাই তেলের কদর প্রাচীনকাল থেকেই। গ্রিক মহাকবি হোমার জলপাই তেলকে বলেছিলেন তরল সোনা। সেই সভ্যতারই আরেক মহাপুরুষ চিকিৎসাবিদ হিপোক্রেটস বলেছিলেন, জলপাই তেল উপশমকারী হিসেবে অনেক কাজের।

এখনকার দিনে জলপাই তেলের ব্যবহার পাল্টে গেছে। মূলত অল্প তেলে সবজি রান্না করা ও সালাদ তৈরিতে ইদানীং জলপাই তেল বেশি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সেই জলপাই এখন আবার বিলাসবহুল হয়ে উঠতে চলেছে। সেপ্টেম্বর মাসে জলপাই তেলের দাম আগের বছরের একই সময়ে তুলনায় ১১৭ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। যখন থেকে রেকর্ড সংরক্ষণ করা হচ্ছে, তারপর জলপাই তেলের দাম এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছে বলে জানিয়েছে দ্য ইকোনমিস্ট।

ওজনের দিক থেকে বিবেচনা করা হলে জলপাই তেল এখন অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের তুলনায় ১৭ গুণ দামি, যদিও ২০১৯ সালে তার দাম সাত ভাগের এক ভাগ ছিল। এখন কথা হলো, জলপাই তেলের দাম কেন বাড়ল।

ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের মানুষের খাদ্যাভ্যাসের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে জলপাই তেল। হিপোক্রেটস সে কথাটাই বলেছিলেন। এরপর বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল যখন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের এই খাবারের গুণাগুণ সম্পর্কে অবগত হলো, তখন অলিভ অয়েল বা জলপাই তেলের চাহিদা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল।

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জলপাই উৎপাদন হয় ইউরোপের দেশ স্পেনে। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জলপাই সে দেশেই উৎপাদিত হয়। এরপর ইতালি ও গ্রিসে। দক্ষিণ ইউরোপের মৃদু শীত ও কখনো কখনো উচ্চ তাপমাত্রা জলপাই উৎপাদনের জন্য ছিল আদর্শ। কিন্তু জলপাইয়ের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সরবরাহ কমতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে দক্ষিণ ইউরোপের দীর্ঘ গ্রীষ্মকাল, খরা ও চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার কারণে জলপাই উৎপাদন কমে যাচ্ছে।

গত মৌসুমের অবস্থা ছিল বিশেষভাবে খারাপ। স্পেনসহ দক্ষিণ ইউরোপে তাপমাত্রা বাড়ছে। ফলে গত বসন্তকালের এপ্রিল মাসে স্পেনের তাপমাত্রা ছিল ওই মাসের গড় তাপমাত্রার চেয়ে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। সে জন্য জলপাইগাছে ফুল ফোটেনি। গ্রীষ্মকালেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। দেশটির পরিবেশ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত বছর জুন মাসে দেশটির এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল দীর্ঘস্থায়ী খরার কবলে পড়েছিল। ফলে যে কিছু গাছে ফুল ফুটেছিল, সেগুলোও নষ্ট হয়েছে।

এদিকে ইতালির তাপমাত্রাও ছিল গা পুড়িয়ে দেওয়ার মতো। সেই সময় ইতালিতে একধরনের পোকার সংক্রমণ হয়। ধারণা করা হয়, ২০০৮ সালে কোস্টারিকা থেকে আনা একধরনের পাতাবাহার গাছ থেকে সেই পোকার বংশবিস্তার ঘটেছে। পোকার সংক্রমণে ২ কোটি ১০ লাখ গাছ মারা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, আবহাওয়ার চরমভাবাপন্নতার কারণে জলপাইগাছে এ ধরনের পোকার সংক্রমণ হতে পারে।

গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোয় জলপাই উৎপাদন ৪০ শতাংশ কমে গেছে বলে স্বাভাবিকভাবেই দাম বেড়েছে।

তবে দুটি কারণে জলপাইয়ের দাম আরও বাড়ছে। প্রথমত, নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে কৃষকদের ঋণ নেওয়ার ব্যয় যেমন বেড়েছে, তেমনি সারের দাম বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, বিশ্বের যেসব দেশে জলপাইয়ের ভালো ফলন হয়েছে, তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে তুরস্ক। কিন্তু তারাও নিজ দেশের বাজারে দাম স্থিতিশীল রাখতে জলপাই তেল রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে। এতে তুরস্কের বাজারে অলিভ অয়েলের দাম স্থিতিশীল থাকলেও বিশ্ববাজার হয়েছে অস্থিতিশীল।

এই পরিস্থিতিতে দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলোয় মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। স্পেনের মতো দেশে জলপাই তেল চুরি হয়েছে। করডোভা প্রদেশের একটি গুদাম থেকে গত আগস্ট মাসে ৫ লাখ ডলার সমমূল্যের জলপাই তেল চুরি হয়। সুপারমার্কেটগুলো থেকে ১১টি ব্র্যান্ডের নিম্নমানের জলপাই তেল সরিয়ে নেয় দেশটির কর্তৃপক্ষ।

আগামী বছরও পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। সেপ্টেম্বর মাসে বৃষ্টির কারণে ইতালির বেশ কিছু অঞ্চলে জলপাইগাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, একই সঙ্গে স্পেনে আরেকটি খরা আসন্ন। স্পেনের কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২৪ সালে দেশটির জলপাই উৎপাদন গত চার বছরের গড় উৎপাদনের চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ কম হবে।

ফলে জলপাই তেল দিয়ে অল্প আঁচে সবজি রান্না করা বা সালাদ সাজানো আরও দামি হয়ে উঠবে বলেই মনে করা হচ্ছে।