উৎপাদনস্থলের চেয়ে ঢাকায় সবজির দাম দ্বিগুণ

এবার কৃষকেরা সবজির ভালো দাম পাচ্ছেন। এরপর হাতবদলে সবজির দাম আরও বেড়ে যাচ্ছে। তাতে ভোক্তাদের ওপর চাপ বেশি পড়ছে। 

যশোর সদর উপজেলার মথুরাপুর গ্রামের সবজিচাষি মনিরুল ইসলাম গতকাল বৃহস্পতিবার বারীনগর পাইকারি সবজির মোকামে ৩০ টাকা কেজি দরে টমেটো এবং ৩৮ টাকায় বেগুন বিক্রি করেন। একই দিনে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার খাদিমপুরের সবজিচাষি তোতা মিয়া পৌর বড় বাজারে বেগুন বিক্রি করেন ৪৫ টাকা কেজি। স্থানীয় এই বাজারে গতকাল টমেটো বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ২০-৩০ টাকায়। 

উৎপাদনস্থলের দামের এই চিত্রের বিপরীতে গতকাল ঢাকার মগবাজার, মালিবাগ ও শাহজাহানপুর বাজারে বেগুনের কেজি বিক্রি হয়েছে ৮০-১০০ টাকায়। জাতভেদে টমেটোর দাম রাখা হচ্ছিল ৫০-৭০ টাকা। বাজারের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, উৎপাদনস্থলের তুলনায় ঢাকার বাজারে শুধু এই দুই পদের সবজি নয়; অধিকাংশ সবজির দাম কখনো দ্বিগুণ, কখনো তার চেয়ে আরও বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।

ঢাকার মালিবাগ বাজারের সবজি বিক্রেতা মো. স্বপন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্যান্যবার শীতের মাঝামাঝি থেকে সবজির দাম কমতে শুরু করলেও, এবার পাইকারিতে এখনো দাম বাড়ছে। বুধবার একটা ব্রকলি পাইকারিতে কিনেছিলাম ৪০ টাকা, আজ (বৃহস্পতিবার) সেটা কিনতে হয়েছে ৭০ টাকায়।’ 

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি, গতবারের তুলনায় এবার উৎপাদনস্থলে বেশি দরে সবজি বিক্রি হচ্ছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছে। তবে কৃষকেরা সবজির যে দাম পাচ্ছেন, তাতে তাঁরা খুশি। সবজির উৎপাদনও অন্যবারের তুলনায় কম হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। 

ঢাকার তিন বাজারে গতকাল প্রতিটি মাঝারি আকারের ফুলকপি বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। বড় আকারের ফুলকপির দাম হাঁকানো হয়েছে প্রতিটি ৮০ টাকা। প্রতিটি বাঁধাকপির দাম ছিল ৫০-৬০ টাকা। প্রতি কেজি শিম বিক্রি হয়েছে মানভেদে ৬০-৮০ টাকায়। ব্রকলি ৭০-৮০ টাকায়। আর ভালো মানের একটি লাউয়ের দাম চাওয়া হচ্ছিল ১০০-১২০ টাকা। ভরা মৌসুমে বাজারে প্রতি কেজি ৫০ টাকার ঘরে সবজি আছে মাত্র তিনটি—পেঁপে, শালগম ও মুলা।

এদিকে যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও বগুড়ার বাজারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব বাজারে পাইকারিতে প্রতি কেজি শিম ২৫-৩০ টাকা, প্রতিটি ফুলকপি ২৮-৩০ টাকায় ও লাউ ৪০-৫০ টাকায় বিক্রি করছেন। অন্যান্য সবজির মধ্যে পেঁপে, শালগম, মুলা ও করলার দামও ঢাকার তুলনায় অর্ধেক বা তার চেয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে স্থানীয় পাইকারি বাজারে। গ্রীষ্মের সবজি হিসেবে পরিচিত ঝিঙে, ধুন্দুল, ঢ্যাঁড়স ও চিচিঙ্গার মতো সবজির দামেও একই অবস্থা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি, গতবারের তুলনায় এবার উৎপাদনস্থলে বেশি দরে সবজি বিক্রি হচ্ছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছে। তবে কৃষকেরা সবজির যে দাম পাচ্ছেন, তাতে তাঁরা খুশি। সবজির উৎপাদনও অন্যবারের তুলনায় কম হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। 

অন্যান্যবার শীতের মাঝামাঝি থেকে সবজির দাম কমতে শুরু করলেও, এবার পাইকারিতে এখনো দাম বাড়ছে। বুধবার একটা ব্রকলি পাইকারিতে কিনেছিলাম ৪০ টাকা, আজ (বৃহস্পতিবার) সেটা কিনতে হয়েছে ৭০ টাকায়।
মো. স্বপন, ঢাকার মালিবাগ বাজারের সবজি বিক্রেতা

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার আলোকদিয়া ইউনিয়নের সবজিচাষি ইনারুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর সাড়ে তিন বিঘা জমিতে ১২ রকম সবজির আবাদ করেছিলাম। খরচ বেশি হওয়ায় এবার ১৯ কাঠা জমিতে তিন জাতের সবজি চাষ করেছি। তবে দাম ভালো। খেত থেকেই প্রতিটি লাউ ৪০ টাকা দরে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। গত বছর যা পাঁচ থেকে আট টাকা দরে বিক্রি করেছিলাম।’ 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চুয়াডাঙ্গার উপপরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছর জেলায় ৮ হাজার ৪৬০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজির আবাদ করা হয়েছিল। এ বছর সেখানে ৮ হাজার ৮০ হেক্টর জমিতে সবজি আবাদ হয়েছে। উৎপাদন পর্যাপ্ত না হওয়ার পাশাপাশি হাতবদলেও বাড়ছে সবজির দাম। তাতে মৌসুমেও রাজধানীতে অনেকটা অস্বাভাবিক দরে সবজি কিনতে হচ্ছে।

বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মতলুবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কৃষকের কাছ থেকে কেনা সবজি হাতবদলের পর মধ্যস্বত্বভোগীরা দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ বেশি দামে সবজি বিক্রি করছেন। সিন্ডিকেটের কারণে ভরা মৌসুমে বাজারে সবজির দাম চড়া। কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধিতে উৎপাদন খরচ কিছুটা বাড়লেও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলনে কমতি নেই বলে জানান তিনি। 

আরও পড়ুন

নিত্যপণ্য উচ্চ মূল্যে স্থিতিশীল

বাজারে চালের মূল্য আরেক দফা বৃদ্ধির পর নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। সরকার বাজার তদারক করলেও তার প্রভাব নেই। আটা-ময়দা, ডাল, ভোজ্যতেল ও চিনির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য উচ্চ মূল্যে স্থিতিশীল। মাছ, মাংস ও ডিমের দামও বেশ চড়া। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২০০-২১০ টাকায়। সোনালি মুরগির কেজি পড়ছে ৩১০-৩৩০ টাকা। গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৬৫০-৭০০ টাকা কেজি। 

ডিমের দাম গত সপ্তাহের তুলনায় ডজনে ৫ টাকা বেড়েছে। ফার্মের মুরগির বাদামি রঙের ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৩৫ টাকায়। চাষের তেলাপিয়া ও পাঙাশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ২২০-২৫০ টাকায়। চাষের রুই মাছের কেজি পড়ছে ৩০০-৪০০ টাকা। মাছের আকার বড় হলে দাম একটু বেশি চাওয়া হচ্ছে।

শাহজাহানপুর বাজারের ক্রেতা আবদুল খালেক প্রথম আলোকে বলেন, কোনো কিছুর দাম কমে না। গরুর মাংসের দাম একটু কমেছিল, তা আবার বেড়েছে। তবে এবার শীতে বেশি কষ্ট হচ্ছে সবজি কিনতে। আগে এত দাম দিয়ে কখনো সবজি কিনতে হয়নি।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন মনিরুল ইসলাম, যশোর; শাহ আলম, চুয়াডাঙ্গা আনোয়ার পারভেজ, বগুড়া