মারুফ মতিনের চলে যাওয়া, প্র-বাণিজ্য ও ব্যক্তিগত দেনা

ওয়ালি উল মারুফ মতিন

সকালে ফোনটা চার্জেই ছিল। ইদানীং সাইলেন্ট মুডে ভাইব্রেশনে দেওয়া থাকে। শেয়ারবাজার নিয়ে প্র–বাণিজ্যের একটা লেখা তৈরি করেছি। সেটাতে নতুন কোনো তথ্য যোগ করা যায় কি না, এ জন্য বুকশেলফে থাকা শেয়ারবাজারসংক্রান্ত কয়েকটি বই নিয়ে নাড়াচাড়া করছি দুদিন ধরে। তারই একটি ‘ওয়ালস্ট্রিট: এ হিস্ট্রি’। চার্লস আর গেইস্টের লেখা বইটি।
বইটির একটি চ্যাপ্টার পড়ে কী মনে করে ফোনটা হাতে নিলাম। দেখি একটা মিসডকল উঠে আছে। কলব্যাক করতে ওই প্রান্তে লাফার্জহোলসিম সিমেন্টের কর্মকর্তা তৌহিদের কণ্ঠ। তৌহিদ একসময় জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। ফোন ধরেই বলে উঠলেন, সকাল সকাল একটি দুঃসংবাদ দিতে ফোন করলাম ভাইজান। বললাম কী দুঃসংবাদ দেবেন এ করোনাকালে আবার। বলতে বলতেই তৌহিদ বললেন, মারুফ ভাই আর নেই। ধাক্কা খেলাম একটু। মারুফ ভাই ও তৌহিদের সম্পর্ক আমি আগে থেকেই জানতাম। বুঝতে কষ্ট হলো না তৌহিদ কোন মারুফ ভাইয়ের কথা বলছেন। কিন্তু আমার যেন কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না, তাই পাল্টা প্রশ্ন করলাম কোন মারুফ ভাই?

প্র বাণিজ্যের প্রথম সংখ্যায় লিখেছিলেন ওয়ালি উল মারুফ মতিন

এবার তৌহিদের উত্তর আমাদের মারুফ মতিন ভাই। আমার ক্যাডেট কলেজের বড় ভাই ও সবদিক থেকে বড় ভাই। হঠাৎই যেন স্তব্ধ হয়ে গেলাম কিছু সময়ের জন্য। চুপচাপ। জানি তৌহিদ মিথ্যা কথা বলার পাত্র নয়। জানালেন, আজ সকাল পৌনে সাতটায় রাজধানীর একটি হাতপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য ফোন দিলাম মারুফ ভাইয়ের বর্তমান প্রতিষ্ঠান মসলিন ক্যাপিটালের একজনকে। ফোন ধরার পর থেকেই ওই প্রান্ত থেকে শুধু হাউমাউ কান্না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে কান্নার শব্দ শুনে গেলাম। পরে নিতে পারলাম না, ফোন কেটে দিয়ে ‘ওয়ালস্ট্রিট: এ হিস্ট্রি’ বইটা হাতে নিলাম পরম মমতায়। কারণ ওই বইয়ে আছে মারুফ ভাইয়ের স্মৃতি।

মারুফ ভাই, মানে ওয়ালি উল মারুফ মতিন। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের একজন অতি পরিচিত মুখ। অতি সজ্জন, মেধাবী ও বন্ধুবৎসল ব্যক্তি। দুই দফায় ছিলেন চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক। নিজের হাতে গড়েছেন একাধিক প্রতিষ্ঠান। তারই একটি মসলিন ক্যাপিটাল। মৃত্যুর আগপর্যন্ত এটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। নতুন নতুন উদ্যোগকে অর্থায়নের মাধ্যমে ব্যবসায়িকভাবে সফল করে তুলতে কাজ করছিল তাঁর প্রতিষ্ঠানটি। তিনি নিজেও দেশে ও দেশের বাইরে শেয়ারবাজারে নতুন নতুন অনেক কিছু করেছেন ও করার চেষ্টা করেছেন। কোনোটাতে সফল হয়েছেন, কোনোটাতে বাস্তবতার কাছে হার মেনেছেন। কিন্তু বরাবরই নতুন কিছু গড়ার চেষ্টা থেকে পিছু হটেননি।

প্র বাণিজ্যের প্রথম সংখ্যায় ওয়ালি উল মারুফ–মতিনের লেখা

এই যেমন দ্বিতীয় দফায় সিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে সরে আসার পর অনেক দিন ধরে চেষ্টা করলেন ‘কমোডিটি এক্সচেঞ্জ’ চালুর। তিনি চেয়েছিলেন প্রথম স্বর্ণ লেনদেনের মাধ্যমে এ কমোডিটি এক্সচেঞ্জটির কাজ শুরু করবেন। তখন বাংলাদেশে বৈধ পথে সোনা আমদানির কোনো সুযোগ ছিল না। তিনি সেই কাজটি শুরু করতে চেয়েছিলেন। এ নিয়ে দৌড়ঝাঁপও করেছেন, কিন্তু পৃষ্ঠপোষক পেলেও সরকারি অনুমোদন পেলেন না, তাই তাঁর সেই স্বপ্নটি অধরাই থেকে গেল।

গত বছরের ২৬ আগস্ট থেকে প্রথম আলোর ব্যবসা–বাণিজ্যবিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন প্র–বাণিজ্যের যাত্রা শুরু হয়। শুরুতে এটির নাম ছিল ‘প্র এবং বাণিজ্য’। বর্তমানে এটি প্র–বাণিজ্য হিসেবে প্রতি সোমবার বের হয়। ওয়ালিউল মারুফ মতিন ছিলেন শুরু থেকে এ আয়োজনের নিয়মিত লেখক। প্র–বাণিজ্যের প্রথম সংখ্যায় ‘ওয়ালিউল মারুফ মতিনের পরামর্শ: বিনিয়োগ ব্যাকরণ’ নামে তাঁর লেখাটি ছাপা হয়। ইদানীং তাঁর সঙ্গে বেশি কথা হতো এ লেখা নিয়েই। ফোন করলে, ধরেই বলতেন, দাদা কবে লাগবে? কিছুদিন লেখার জন্য না বললে নিজেই ফোন করে রসিকতা করে বলতেন ‘আমাকে বাদ দিয়ে দিলেন?’ না তাঁকে আমরা বাদ দিইনি। বরং তিনিই আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন, যেখান থেকে মানুষ আর কোনো দিন ফেরে না। কীই–বা বয়স হয়েছিল। মাত্রই তো ৫৮ বছর। ১৯৬২ সালে জন্ম। একাবারে সবদিক থেকে সচল মানুষটার হৃদযন্ত্র হঠাৎই অচল হয়ে গেল।

পরিচয়ের দিনক্ষণটা ঠিক মনে নেই। পরিচিত একজনের মাধ্যমে আমার সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ দেখালেন। তখন তিনি অ্যালায়েন্স ক্যাপিটাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট নামের তাঁর গড়া সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। পরে সেটির মালিকানা বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তো কথা বলার আকাঙ্ক্ষার কথা জানতে পেরে একদিন গেলাম তাঁর ইস্কাটনের সেই অফিসে। সেই দিনই দীর্ঘ সময় ধরে আলাপন। এরপর যোগাযোগে আর ছেদ পড়েনি। প্রয়োজনে–অপ্রয়োজনে শেয়ারবাজার, নতুন উদ্যোগ, নানা বিষয়ে নিয়মিত বিরতিতে কথা হতো।

বইয়ের সঙ্গে এক চিরকুটে লিখে দিয়েছিলেন ‘দ্রুত ফেরত’ দেওয়ার কথা।

সর্বশেষ নিজের ছোট ভাইয়ের একটি গবেষণাসংক্রান্ত সহায়তার বিষয়ে কথা হয়েছিল। কথা শেষে বললেন, একদিন অফিসে আসেন আড্ডা দিই। অনেক কথা জমেছে। সেই জমানো কথা না শুনিয়েই চলে গেলেন মারুফ ভাই।

আমি ডাকতাম মারুফ ভাই, তিনি ডাকতেন দাদা। তিনি মারা গেছেন, জানার পর মাথার ভেতরটা কেমন যেন শূন্য লাগছিল। ‘ওয়ালস্ট্রিট: এ হিস্ট্রি’ বইটি আবার হাতে নিলাম। ২০১৬ সালে বইটি আমাকে ধার দিয়েছিলেন পড়ার জন্য। বইয়ের সঙ্গে এক চিরকুটে লিখে দিয়েছিলেন ‘দ্রুত ফেরত’ দেওয়ার কথা বলে। চার বছরেও ধারের বইটি ফেরত দেওয়া হয়নি। উনারই সম্মতিতে আমি বারবার ধারের মেয়াদ বাড়িয়েছি। কে জানত, শেষ পর্যন্ত বইটিই উনার স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে আমার কাছে। এখন আমি বইটি কাকে ফেরত দেব?

‘দ্য ফোরথ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভুলেশন’ বইটি ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’ নামে সম্প্রতি বাংলায় অনুবাদ করেন ওয়ালি উল মারুফ–মতিন

ওয়াল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সভাপতি ক্লাউস শোয়াবের সাড়াজাগানো বই ‘দ্য ফোরথ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভুলেশন’ বইটি ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’ নামে সম্প্রতি বাংলায় অনুবাদ করেন তিনি। বইটি অনুবাদের চাপেই কিছুদিন প্র–বাণিজ্যের জন্য লিখতে পারছেন না বলেও জানিয়েছিলেন। বলেছিলাম বইটি কিনব। তিনি বলেছিলেন আপনার কিনতে হবে না– আপনার জন্য আমি কপি পাঠিয়ে দিব। মারুফ ভাই আমি সেই কপির অপেক্ষায়। আর অপেক্ষায় আছি প্র–বাণিজ্যের জন্য ‘বিনিয়োগ ব্যাকরণ’ নামে আপনার সেই লেখার। বাংলা টাইপ করতে পারতেন না বলে কাগজে লিখে পাঠাতেন, সেই লেখা আমি নিজে টাইপ করতাম। আর আজ সেই আমাকে টাইপ করতে হলো আপনার জন্য শোকগাঁথা। আর স্মৃতিতে রেখে দিলাম সেই ধারের বই ও চিরকুটখানি। আপনি ভালো থাকুন ওপারে।