এ বছর অনলাইনে রিটার্ন জমার সুবিধা পাচ্ছেন না করদাতারা

অনলাইনে রিটার্ন জমা দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন এক করদাতা। সম্প্রতি রাজধানীর সেগুনবাগিচায় কর অঞ্চল-৭-এ
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) দেওয়া ২০২০ সালের অক্টোবরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ৭ লাখ ৬২ হাজার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক ৪ কোটি ১০ লাখ।

অন্যদিকে করোনার কারণে কেনাকাটা থেকে শুরু করে লেনদেনের ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে বেড়েছে অনলাইন নির্ভরতা।

এ যখন প্রবণতা, তখন অনলাইনে আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন দাখিলের প্রবণতাটির চিত্রটি একেবারেই উল্টো। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে সর্বসাকল্যে ৫ হাজার ৮৪৮ জন করদাতা অনলাইনে তাঁদের রিটার্ন জমা দিয়েছেন। এ বছর করোনার মধ্যে অনলাইন রিটার্ন দেওয়ার সুযোগটিই বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু ঢাকার কর অঞ্চল-৬ নিজস্ব উদ্যোগে অনলাইনে রিটার্ন দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করে। তাও নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে। তবে প্রচার-প্রচারণার অভাবে করদাতারা এ সুবিধার কথা জানতে পারেননি। এ কারণে প্রত্যাশিত সাড়াও মিলছে না কর অঞ্চল-৬-এর অনলাইনে রিটার্ন জমার আয়োজনে। কিন্তু বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার করদাতারা জানান, করোনার এ সময়ে অনলাইনে রিটার্ন জমার সুযোগ থাকলে সেটি করদাতাদের অনেক বেশি স্বস্তি দিত।

গত ৩০ নভেম্বর কর দিবসে ঢাকার সেগুনবাগিচা এলাকার বিভিন্ন কর অঞ্চল ঘুরে দেখা যায়, করোনার মধ্যে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যে করদাতারা রিটার্ন জমা দেন। কিন্তু অনলাইনে রিটার্ন দেওয়ার সুযোগ থাকলে এ ভিড় এড়ানো যেত বলে মনে করেন অনেক করদাতা। ওই দিনই কথা হয় কর অঞ্চল-১১-তে রিটার্ন জমা দিতে আসা করদাতা স্কুলশিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, করোনায় যেখানে সবাই ঘরে বসে অনলাইনের পথে এগোচ্ছেন, সেখানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর চলছে উল্টো পথে।

করোনায় যেখানে সবাই ঘরে বসে অনলাইনের পথে এগোচ্ছেন, সেখানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর চলছে উল্টো পথে।
সাবিনা ইয়াসমিন, কর অঞ্চল-১১-তে রিটার্ন জমা দিতে আসা করদাতা স্কুলশিক্ষক

বাংলাদেশে বর্তমানে কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএনধারী করদাতা রয়েছেন প্রায় ৫০ লাখ ৭২ হাজার জন। গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন ১৫ লাখের বেশি করদাতা। আইন করে ৩০ নভেম্বরকে রিটার্ন জমার শেষ দিন হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। এ কারণে কয়েক বছর ধরে রিটার্ন জমার সময় বাড়ানো হয়নি। কিন্তু এবার করোনার কারণে করদাতাদের দিক থেকে সময় বাড়ানোর দাবি জানানো হয়। এমন এক প্রেক্ষাপটে ২৯ নভেম্বর এনবিআর চেয়ারম্যান সংবাদ সম্মেলন করে সময় না বাড়ানোর ঘোষণা দেন। তার পরদিন বিকেলেই আবার এক মাস সময় বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়।

ভোগান্তি বেড়েছে

এ বছর অনলাইনে রিটার্ন জমা দেওয়া যাবে না—বিষয়টি জানতেন না করদাতারা। এনবিআরের পক্ষ থেকেও সেটি জানানো হয়নি। ফলে অনেক করদাতা অনলাইনে রিটার্ন দিতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েন। ৩০ নভেম্বর বেশ কিছু কর অঞ্চলে গিয়ে দেখা যায়, তরুণ করদাতাদের অনেকে অনলাইনে কর দেওয়ার চেষ্টা করে ওয়েবসাইটে লিংকটি খুলতেই পারছিলেন না।

জানতে চাওয়া হলে এনবিআরের সদস্য হাফিজ আহমেদ মুর্শেদ স্বীকার করেন, অনলাইনে রিটার্ন জমা দিতে না পারার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে করদাতাদের জানানো হয়নি।

২০১১ থেকে ২০১৮ সাল মেয়াদে স্ট্রেনদেনিং গভর্ন্যান্স ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ ইন্টিগ্রেটেড ট্যাক্স (বাইট্যাক্স) সিস্টেম চালু করা হয়েছিল। এ বছর তা বন্ধ হয়ে যায়। এনবিআর সিস্টেম বা সফটওয়্যার তৈরির কাজটি পেয়েছিল ভিয়েতনামের প্রতিষ্ঠান এফটিপি। কিন্তু এনবিআরকে করদাতার তথ্যভান্ডার বুঝিয়ে না দিয়েই চলে যায় প্রতিষ্ঠানটি। যার কারণে এ বছর অনলাইনে রিটার্ন জমার সুবিধাটি বন্ধ হয়ে যায়।

৫ লাখ টাকায় নতুন অনলাইন সিস্টেম

প্রতিবছর ১ জুলাই থেকে রিটার্ন জমার সময় শুরু হয়। শেষ হয় ৩০ নভেম্বর। করোনার মধ্যে করদাতাদের সুবিধার কথাটি মাথায় রেখে কর অঞ্চল-৬-এর পক্ষ থেকে এ বছর নিজস্ব উদ্যোগে অনলাইনে কর জমা দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করা হয় ১৫ নভেম্বর। যদিও প্রচার-প্রচারণার অভাবে করদাতারা এর সুফল পাননি।

গত সোমবার এ কর অঞ্চলে রিটার্ন জমা দিতে আসা করদাতা ইশরাত জাহান প্রথম আলোকে বলেন, এ কর অঞ্চলে অনলাইনে রিটার্ন দেওয়ার সুযোগ আছে জানলে সশরীর অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আসতে হতো না।

এ কর অঞ্চলে অনলাইনে রিটার্ন দেওয়ার সুযোগ আছে জানলে সশরীর অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আসতে হতো না।
ইশরাত জাহান , এ কর অঞ্চলে রিটার্ন জমা দিতে আসা করদাতা

কর অঞ্চল-৬-এর নিবন্ধিত করদাতা ১ লাখ ৩৬ হাজার ৭৫৮ জন। এর মধ্যে নিয়মিত রিটার্ন দেন ৮৬ হাজারের মতো। এ বছর ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত রিটার্ন জমা দিয়েছেন ৬২ হাজার ১৯৬ জন, যার মধ্যে মাত্র ১ হাজার ৩৩৪ জন অনলাইনে রিটার্ন জমা দেন।

জানতে চাইলে কর অঞ্চল-৬-এর কমিশনার মো. জাহিদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিজেদের তথ্যপ্রযুক্তি ও কর্মকর্তাদের সহায়তায় মাত্র ৫ লাখ টাকায় অনলাইনে রিটার্ন দেওয়ার ব্যবস্থাটি তৈরি করা হয়েছে। মাত্র ১৫ দিনে যে সাড়া মিলেছে, তাতে আমাদের জন্য মোটেই হতাশাব্যঞ্জক নয়।’

এদিকে এনবিআর সদস্য হাফিজ আহমেদ মুর্শেদ প্রথম আলোকে বলেন, কর অঞ্চল-৬-এর মতো অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের ব্যবস্থাটি আগামী বছর থেকে সব কর অঞ্চলে চালু করা যায় কি না, তার জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণের কথা ভাবছে এনবিআর।

‘নিজেদের তথ্যপ্রযুক্তি ও কর্মকর্তাদের সহায়তায় মাত্র ৫ লাখ টাকায় অনলাইনে রিটার্ন দেওয়ার ব্যবস্থাটি তৈরি করা হয়েছে। মাত্র ১৫ দিনে যে সাড়া মিলেছে, তাতে আমাদের জন্য মোটেই হতাশাব্যঞ্জক নয়।’
মো. জাহিদ হাসান, কর অঞ্চল-৬-এর কমিশনার