দুই বছর পরও চলছে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব

পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার অর্থনীতি ধসে পড়ার আশঙ্কা করা হলেও তা হয়নি; বরং রাশিয়ার অর্থনীতি পশ্চিমা বিশ্বের চেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পশ্চিমারা রাশিয়ার ওপর যত ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাতে প্রাথমিকভাবে অনেকেরই মনে হয়েছিল, দেশটির অর্থনীতি ধসে পড়বে। বাস্তবে তা হয়নি। পশ্চিমা অনেক দেশের তুলনায় রাশিয়ার অর্থনীতি বরং এখন ভালো অবস্থায় রয়েছে; যদিও অন্যান্য দেশে তার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে।

কিন্তু এই যুদ্ধের কারণে বিশ্বের প্রায় সব দেশ কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এতে মহাবিপাকে পড়ে জ্বালানি আমদানিকারক দেশগুলো। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পায় মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য। এই দুই চাপে পড়ে রীতিমতো দিশাহারা হয়ে যায় অনেক দেশ। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতির হার রেকর্ড উচ্চতায় উঠে যায়। বাংলাদেশ এই উভয় চাপে পড়ে আমদানি সীমিত করতে বাধ্য হয়, যার জের এখনো চলছে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে যায়।

ইউরোপের দেশগুলো যদি সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করে, তাহলে সেখানকার মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। ইউরোপ বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের অন্যতম বৃহৎ গন্তব্য।
সেলিম রায়হান, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপর কৃষ্ণসাগর দিয়ে খাদ্য পরিবহন ব্যাহত হলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে যায়। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর ২০২২ সালের মার্চ মাসে এ সূচক রেকর্ড ১৫৯ দশমিক ৭ পয়েন্টে উঠেছিল; এর পরের চার মাসেও তার মান ১৫০-এর ওপরে ছিল। বাস্তবতা হলো ১৯৯০ সালে এফএওর সূচক প্রবর্তনের পর ২০২২ সালে বিশ্বে খাদ্যের দাম ছিল সবচেয়ে বেশি।

 এদিকে যুদ্ধ ও হাজার রকম নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের চেয়ে রাশিয়ার ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত বছর দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, যদিও ২০২২ সালে রাশিয়ার অর্থনীতি ১ দশমিক ২ শতাংশ সংকুচিত হয়েছিল। অন্যদিকে ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৫ শতাংশ। এই দুই দেশের অর্থনীতির আকার অবশ্য এক নয়। চলতি ২০২৪ সালেও রাশিয়ার ভালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস হচ্ছে, চলতি বছর রাশিয়ার প্রবৃদ্ধি হবে ২ দশমিক ৬ শতাংশ। যদিও দেশটির সরকারের পূর্বাভাস, প্রবৃদ্ধি হবে ২ দশমিক ৩ শতাংশ।

আরও পড়ুন

বিশ্বের দুই বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি জাপান ও যুক্তরাজ্য ২০২০ সালের পর আবার আনুষ্ঠানিকভাবে মন্দার কবলে পড়েছে। এই দেশ দুটিতে টানা দুই প্রান্তিকে জিডিপির সংকোচন হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রেও মন্দা হবে কি না।

বাস্তবতা হচ্ছে, ২০২০ সালের মহামারির প্রভাব যতটা দ্রুত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হলেও এই যুদ্ধের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। যুদ্ধের জেরে রাশিয়ার জ্বালানিতে বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কারণে উন্নত দেশসহ সব দেশকেই অনেক বেশি দামে জ্বালানি কিনতে হয়েছে। এতে মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে শুরু করলে দেশে দেশে যে আগ্রাসীভাবে নীতি সুদহার বাড়ানো শুরু হয়, তার জেরে প্রবৃদ্ধির গতি কমে গেছে। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস, মহামারির পর ২০২৪ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি হবে সবচেয়ে কম। অর্থাৎ বিশ্ব অর্থনীতি এখনো যুদ্ধের ছায়া থেকে বেরোতে পারছে না।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ভূরাজনৈতিক সমীকরণ যেভাবে বদলে যাচ্ছে তাতে উত্তেজনা শিগগিরই প্রশমিত হবে বলে মনে হয় না, বরং তা আরও বাড়বে বলেই শঙ্কা। ইউরোপের দেশগুলো যদি সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করে, তাহলে সেখানকার মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। ইউরোপ বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের অন্যতম বৃহৎ গন্তব্য। এ ছাড়া আছে পানামা খালে হুতিদের হামলা। এতে জাহাজ ভাড়া বাড়ছে। সব মিলে কাঁচমাল সংগ্রহের ব্যয় বেড়ে যেতে পারে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির হার আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে।   

আরও পড়ুন

ব্রিকসের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে

এদিকে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার নেতৃত্বাধীন জোট ব্রিকসের প্রতি অন্যান্য দেশের আগ্রহ বাড়ছে। গত বছর প্রায় ৪০টি দেশ এই জোটে যোগ দেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ২২টি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন জানায়। শেষমেশ ছয়টি দেশকে ব্রিকসের সদস্যপদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সামগ্রিকভাবে পশ্চিমাদের নেতৃত্বাধীন বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার বিপরীতে ব্রিকসের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, যার নেতৃত্বে আছে রাশিয়া ও চীন।

গত দুই বছরে সারা বিশ্বে ডিডলারাইজেশন ত্বরান্বিত হয়েছে। শুধু রাশিয়া বা পশ্চিমাবিরোধী দেশগুলো নয়, যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত অনেক দেশও ডলারের পরিবর্তে অন্যান্য মুদ্রায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত রাখতে শুরু করেছে। অন্যান্য মুদ্রায় বাণিজ্যও বাড়ছে। ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিক (জুলাই-অক্টোবর) শেষে বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রায় ডলারের হিস্যা কমে ৫৯ দশমিক ২ শতাংশে নেমে আসে, ২০০০ সালে যা ছিল ৭০ শতাংশ।

এদিকে চীনা মুদ্রা ইউয়ান ও রুশ মুদ্রা রুবলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাড়ছে। সৌদি আরবের কাছ থেকে চীন নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ানে তেল কেনার বন্দোবস্ত প্রায় করে ফেলেছে। বস্তুত রাশিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি রোধে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ যেভাবে আগ্রাসী হারে নীতি সুদহার বাড়ায়, এর জেরে ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি পায়। এতে বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই প্রবল ডলার-সংকট দেখা দেয়। অনেক দেশ বাধ্য হয়ে ডলারের পরিবর্তে অন্যান্য মুদ্রায় লেনদেন শুরু করে। ব্রিকসও ডলারের পরিবর্তে অভিন্ন মুদ্রা বা নিজেদের সদস্যদেশের মুদ্রায় লেনদেন করতে চায়।

দুই বছর পর কোথায় অর্থনীতি

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারির পর আজ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দুই বছর পূর্তি হলো। এই সময়ে জ্বালানি তেলের দাম কমে যুদ্ধের আগের পর্যায়ে ফিরেছে। বাস্তবতা হচ্ছে, মূল্যবৃদ্ধি ও উচ্চ নীতি সুদহারের কারণে চাহিদা কমে যাওয়ায় তেলের দাম কমে এসেছে, বিশেষ করে চীনের অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তেলের দাম অনেকটাই কমেছে। তা সত্ত্বেও ডলারের উচ্চ বিনিময় মূল্যের কারণে বাংলাদেশসহ অনেক দেশ তার সুফল খুব একটা পাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে মূল্যস্ফীতির হার ২০২২ সালে ৯ শতাংশে উঠলেও এখন তা ৩ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে, যদিও বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে মন্দা অবস্থা কাটাতে পারছে না বিশ্ব অর্থনীতি।