কৃষকদের ভাত না দিয়ে কিল মারা হচ্ছে

জঁ দ্রেজ

ভারতের নতুন তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে মাসাধিককাল ধরে আন্দোলন চলছে। ১২ জানুয়ারি কৃষি আইনে স্থগিতাদেশ দিয়ে কমিটি গঠন করেছেন ভারতের শীর্ষ আদালত। প্রতিবাদরত কৃষকদের সঙ্গে আলোচনার লক্ষ্যে সে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরপর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার দেড় বছরের জন্য কৃষি আইন স্থগিতের প্রস্তাব দিয়েছে, যদিও কৃষকেরা তা মানতে নারাজ। তাঁদের দাবি, ফসলের ন্যূনতম মূল্য নিশ্চিতের পাশাপাশি নতুন তিন আইন বাতিল করা হোক। নতুন এই তিন আইন নিয়ে অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ ইকোনমিক টাইমসে একটি বিশ্লেষণধর্মী কলাম লেখেন ২২ ডিসেম্বর। নতুন এই তিন আইন যেমন বাতিল হয়নি, তেমনি সংশোধিতও হয়নি, তাই রচনাটির প্রাসঙ্গিকতা আছে—অনুবাদক।

ভারতের কৃষকসমাজ ও সরকারের মধ্যে যে বিবাদ চলছে, তাতে কার পক্ষে দাঁড়াব, সেটা ঠিক করা কঠিন কাজ নয়। একপক্ষে রয়েছে অত্যন্ত সাহসী ও দৃঢ়চেতা কৃষকসমাজ। এরা অহিংস আন্দোলন ও সংহতির চমৎকার উদাহরণ আমাদের সামনে তুলে ধরছে। অপরপক্ষে আছে স্বৈরাচারী সরকার। কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে যারা জঘন্য অপবাদ দিয়েই যাচ্ছে, চেষ্টা করছে ঐক্য ভেঙে দেওয়ার, এ লক্ষ্যে তাদের অপচেষ্টার কমতি নেই। স্বাভাবিকভাবে মানুষের সহানুভূতি ও সমর্থন কৃষকদের পক্ষে।

অবশ্য ব্যাপারটা এখানেই নিষ্পত্তি হয়ে যায় না। ভারত সরকার ও সমর্থক গোষ্ঠীর দাবি, কৃষকেরা ভুল করছেন। তাঁরা বিপথে পরিচালিত হচ্ছেন। বাস্তবিকই কি ঘটনাটা সে রকম? সরকারপক্ষের দাবি, কৃষকেরা নিজেদের স্বার্থ বুঝতে পারছেন না, তাঁরা বিভ্রান্তির শিকার। কৃষকেরা নাকি বুঝতেই পারছেন না যে সরকার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাদের ‘সুবিধার্থে’ তিনটি আইন, বিশেষত ফারমার্স প্রডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রমোশন অ্যান্ড ফ্যাসিলিটেশন) অ্যাক্ট ২০২০ নামে যে আইন পাস করেছে, তাতে কৃষকেরাই আদতে লাভবান হবেন।

যুক্তিটা এ রকম: এখন পর্যন্ত কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত ফসল ‘অ্যাগ্রিকালচারাল প্রডিউস মার্কেট কমিটিস (এপিএমসি)’-র কাছে বিক্রি করতে বাধ্য। এই এপিএমসির নিয়ন্ত্রকেরা কৃষকদের শোষণ করে। নতুন আইনটির ডাকনাম হলো ‘এপিএমসি বাইপাস অ্যাক্ট’। তবে এই আইনে এপিএমসি ভেঙে দেওয়া হবে না। বরং এর বাইরে নতুন আরেক বিপণনব্যবস্থা তৈরি করা হবে, যেখানে কৃষকেরা তাঁদের পছন্দমতো যে কারও কাছে পণ্য বিক্রি করতে পারবেন। আর তাতে নাকি কৃষকদের মুক্তি।

ভারত সরকার ও সমর্থক গোষ্ঠীর দাবি, কৃষকেরা ভুল করছেন। তাঁরা বিপথে পরিচালিত হচ্ছেন। বাস্তবিকই কি ঘটনাটা সে রকম?

কথাটা শুনতে ভালো, কিন্তু আদতে বিভ্রান্তিকর। প্রথম কথা হলো, কৃষকেরা এপিএমসির কাছেই পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য, অন্যত্র বিক্রি করতে পারেন না—এ কথা আগাগোড়া ভুল। ওয়াকিবহাল বিদ্যাবেত্তারা দেখিয়েছেন, বস্তুত কৃষিপণ্য বিপণনের বড় অংশটিই হয়ে থাকে এপিএমসির বাইরে। এ কথা ঠিক, বিশেষ কিছু এলাকায় বিশেষ কিছু কৃষিপণ্যের বেশির ভাগটাই এপিএমসির মাধ্যমে বিপণন হয়, যেমন পাঞ্জাবে ধান ও গম। কারণ, কৃষকেরা এপিএমসিতে ভালো দাম বা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পান।

কোনো কোনো রাজ্যের এপিএমসি আইন অনুযায়ী, এপিএমসির বাইরে কৃষিপণ্য বিক্রির ব্যাপারে বিধিনিষেধ নেই, যদিও পাইকারি ব্যবসায়ীদের ওপর সেটা আছে।
এপিএমসি-বহির্ভূত বাণিজ্যের পরিসর যেভাবে ‘মুক্তবাজার’ বলে ধরে নেওয়া হয়, কার্যত সেটা তা নয়। ‘এপিএমসিকে পাশ কাটানো আইন’ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ আটকাতে পারে না, বরং এই আইনকে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের একটা নতুন কাঠামো হিসেবে দেখা যেতে পারে। এটি এমন এক উদ্ভট কাঠামো, যেখানে এপিএমসি নিয়ন্ত্রণ করবে রাজ্য সরকার, আর বাদ বাকি সবকিছু থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে।

নিশ্চিতভাবেই এপিএমসির আওতাবহির্ভূত পরিসরে এ আইন কেন্দ্রীয় সরকারকে তথাকথিত ‘বাণিজ্য অঞ্চল’-এর নামে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের ব্যাপক ক্ষমতা দিয়েছে। ‘এপিএমসিকে পাশ কাটানো আইন’টিকে ‘কৃষি বিপণন দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ আইন’ বা সংক্ষেপে ডিআরএএম (‘ড্রামা’) নামে ডাকতে পারি।

বাণিজ্যিক অঞ্চলে বিধিনিষেধ প্রয়োগের ব্যবস্থা থাকা অবশ্যই ভালো। অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা জনগণের স্বার্থের সহায়ক—এই ধারণা সাধারণভাবেই ভুল এবং কৃষিক্ষেত্রে জন্য খুবই গোলমেলে। অনিয়ন্ত্রিত কৃষিপণ্যের বাজার প্রায়শই কিছু সমস্যা তৈরি করে থাকে। যেমন অনিশ্চয়তা, ভারসাম্যহীনতা, বাণিজ্যিক যোগসাজশ, গুণাগুণ নিয়ন্ত্রণ, তথ্যের অসম প্রবাহ, ব্যবসার বহর, চুক্তি বাস্তবায়ন সমস্যা, অর্থনীতিবহির্ভূত ক্ষমতার অপপ্রয়োগ ইত্যাদি।

জঁ দ্রেজ

বাস্তবে এগুলো তথাকথিত বাজার ব্যর্থতার অনেকগুলো ক্ষেত্রের কয়েকটি মাত্র। তাই কৃষিপণ্যের বাজারের জন্য সাধারণভাবে কিছু নিয়ন্ত্রণ দরকার হয় অথবা বিভিন্ন ধরনের কৃষক সমবায় গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে ভারতে দুগ্ধ সমবায়গুলোর সাফল্য মুক্তবাজার অর্থনীতির পরিসর থেকে বেরিয়ে গঠনমূলকভাবে নতুন ব্যবস্থার পথ খুলে দিয়েছে। সুতরাং আসল প্রশ্নটা বাজার ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ বনাম মুক্তবাজার নয়, বরং প্রশ্ন হচ্ছে, বাণিজ্যিক অঞ্চলে কী ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাশিত।

ড্রামা এই প্রশ্নের উত্তর দেয় না। শুধু নিয়ন্ত্রণযোগ্য বিষয়গুলোর সম্ভাব্য তালিকা পাওয়া যায় এতে। যেমন বাণিজ্য পদ্ধতি, শুল্ক, কারিগরি বৈশিষ্ট্য, সরবরাহব্যবস্থা, গুণগত মান নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা, অর্থ পরিশোধের সময়সীমা ও এ রকম আরও অন্যান্য বিষয়। এসব বিষয় নির্ধারণের সব ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিষয়টি অনেকটা সাম্প্রতিক সময়ের শ্রমবিধির মতো। লক্ষণীয়, ড্রামার অধীনে বিধিনিষেধ তৈরির একচ্ছত্র ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতেই থাকছে। এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারগুলোর বলার হক নেই।

এই ক্ষমতা যে প্রধানত বৃহৎ কৃষি ব্যবসায়ী ও অন্য করপোরেটদের স্বার্থে কাজে লাগানো হবে, এটা বুঝতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দরকার নেই। ড্রামার নথি থেকে এটা স্পষ্ট, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান মনোযোগ থাকবে ইলেকট্রনিক বাণিজ্যে। এটির মূল লক্ষ্য হলো, জাতীয় পর্যায়ে অনলাইনভিত্তিক বাণিজ্যের ব্যাপক বিস্তার, যার নিয়ন্ত্রণ থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হবে বাধ্যতামূলক আধার প্রোগ্রাম, ডিজিটাল লেনদেনব্যবস্থা, তথ্য সংগ্রহ, ইলেকট্রনিক আর্থিক সেবা, তথাকথিত বড় ‘কৃষি ফার্ম হাউস’ ও এ রকম রকমারি জিনিস। কৃষকদের সাহায্যের নামে এই ড্রামা বা নাটক আয়োজিত হলেও পর্দার আড়ালে আছে সেই বাণিজ্যিক স্বার্থ।

আরও পড়ুন

সম্প্রতি অন্যান্য ক্ষেত্রে কেন্দ্রীকরণের অভিজ্ঞতা বিচার-বিশ্লেষণ করলেও একই বিষয় দেখা যাবে। যেমন জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন (এনআরইজিএ) এবং পণ্য ও সেবা কর (জিএসটি)। এ দুটিতে যে মারাত্মক কিছু সমস্যা আছে, সেগুলো নতুন ইলেকট্রনিক ব্যবস্থায়ও থেকে যাবে। কিন্তু এর চেয়েও গুরুতর সমস্যা হলো, কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে এগুলো চলে গেলে বাণিজ্যিক এলাকায় কৃষিপণ্য বিপণনের বিষয়ে কৃষক বা রাজ্য সরকার, কারোরই কিছু বলার থাকবে না।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, ড্রামা থেকে কৃষক সুবিধা পাবেন না। নতুন কৃষি আইনে এপিএমসি মান্ডিগুলোর ভবিষ্যৎ পরিষ্কার নয়। মান্ডির ভূমিকা হচ্ছে কৃষিপণ্য বিপণনে একাধারে নিয়ন্ত্রণ এবং অন্যদিকে যৌথ কার্যক্রম বৃদ্ধিতে সহায়তা করা। মান্ডি সর্বভোগ্য জিনিস। সাম্প্রতিক সংস্কার সত্ত্বেও মান্ডির এই দিকটির প্রতি ন্যায্যতা দেখানো হয়নি। কিন্তু বিষয়টি অপরিবর্তনীয় নয়।

নতুন কৃষি আইনে মান্ডির অস্তিত্বই সংকটে পড়েছে। বাণিজ্যিক এলাকার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তাদেরহয়তো ফি কমাতে হতে পারে। বর্ধিত ফি কিছুটা ছেঁটে দেওয়া অবশ্য খারাপ কিছু নয়। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। ফি কমিয়ে দেওয়ার কারণে মান্ডির পক্ষে সর্বসাধারণের জন্য অবকাঠামো ও অন্যান্য পরিষেবা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে, যদি না রাজ্য সরকার কিংবা স্থানীয় সরকার এতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। ফলে মান্ডির দুরবস্থা হলে নতুন কৃষি আইন কৃষকের কাজেই আসবে না।

এটি অস্বীকার করার উপায় নেই, চলমান কৃষিপণ্য বিপণনে দক্ষতা, সমতা ও বজায় যোগ্যতার প্রশ্নে মারাত্মক ঘাটতি আছে। কিন্তু ড্রামা বা দ্বৈত নিয়ন্ত্রণকাঠামো সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। এটি মূলত জীর্ণ অর্থনৈতিক চিন্তা। কারণ, এটি সমস্যার গোড়ায় যেতে পারেনি। উল্টো কৃষিপণ্যের বিপণনব্যবস্থায় কৃষকের নিয়ন্ত্রণ কমে যাবে এতে। ফলে দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার কৃষকদের ভাত দিতে না পারলেও গোঁসাই হয়ে কিল মারার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। যেটা দরকার সেটা হলো, কৃষি সংস্কারসংক্রান্ত পরিকল্পনায় কৃষকদের মতামতের যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া। বৃহৎ কৃষি ব্যবসায়ী, সফটওয়্যার কোম্পানি ও তথ্য দালালদের যত কম গুরুত্ব দেওয়া যাবে, ততই মঙ্গল।
–দা ইকোনমিক টাইমস থেকে অনুবাদ

জঁ দ্রেজ: ভারতের রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অতিথি অধ্যাপক।
অনুবাদ: আহমেদ জাভেদ, দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং বাঙলার পাঠশালা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি।