কেনার সাধ্য কম, রোজার পণ্যে চাহিদায় ভাটা

রোজার পণ্য আমদানি গত বছরের তুলনায় কম। খেজুর ছাড়া ছোলা, মটর, মসুর ডাল ও ভোজ্যতেলের দাম পড়তির দিকে।

রোজার সময় ছোলা, মসুর ডাল, মটর ডাল, ভোজ্যতেল ও চিনির চাহিদা বাড়ে
ছবি: প্রথম আলো

রমজান মাসে ইফতারে ছোলা খাওয়া হয় বেশি। ব্যবসায়ীরাও মূলত রোজার আগে ছোলা আমদানি করেন। কিন্তু গত রমজানের তুলনায় এবার এই পণ্যের আমদানি কম।

খুচরা বাজারে এখন ভালো মানের ছোলা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৮৫ টাকায়। আর দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে গতকাল ছোলা বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৭০–৭৫ টাকায়।

আমদানির তথ্য ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঋণপত্র–সংকটে খাদ্যপণ্য আমদানি কয়েক মাস ধরে কমছিল। এ পরিস্থিতিতে জানুয়ারি মাসে রোজার পণ্য আমদানিতে ব্যাংকগুলোকে ঋণপত্র খোলায় নির্দেশনা দেয় সরকার। এ নির্দেশনায় কাজ হয়। ঋণপত্র খুলতে পারেন ব্যবসায়ীরা। তাতে ফেব্রুয়ারি থেকে আমদানি কিছুটা বাড়তে থাকে। কমতে থাকে ঘাটতিও।

আরও পড়ুন
মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে খাদ্যপণ্যের চাহিদায়ও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। রোজার পণ্যের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।
মোস্তাফিজুর রহমান, বিশেষ ফেলো, সিপিডি

তবে আমদানির তথ্য ও দাম তুলনা করে দেখা গেছে, যেসব পণ্যের আমদানি খুব বেশি কমেছে, সেগুলোর দাম রোজার আগেই বেড়ে গেছে। আর আমদানি খুব বেশি কমেনি বা চাহিদা আনুযায়ী আমদানি হয়েছে, এমন পণ্যের দাম যেমন কমেছে, তেমনি কিছু পণ্যের দাম স্থিতিশীল রয়েছে।

ব্যবসায়ী ও কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, বাজারে বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম–ই বাড়তি। জীবনযাপনের খরচও বেড়ে গেছে। তাতে বাড়তি ব্যয়ের চাপে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। রোজাকে কেন্দ্র করে আগে শবে বরাতের পর থেকে পুরোদমে বেচাকেনা শুরু হতো। এবার বাজারে এখন পর্যন্ত সেই চাপ নেই। আবার মাসের শেষ দিকে রোজা শুরু হওয়ায় কেনাকাটার চাপ কম থাকতে পারে বলেও কেউ কেউ ধারণা করছেন।

রোজার পণ্যের বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, প্রতিবছর রোজার আগে পাইকারি বাজারে পণ্য বিক্রির চাপ থাকে বেশি। এবার তেমনটি হয়নি। রোজার পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। উল্টো ডালজাতীয় পণ্যের দাম কমেছে। আমদানি কমলেও এবার সমস্যা হবে না।

আরও পড়ুন

আমদানি কম, দামও কমছে ডালের

রোজার মূলত দুই–আড়াই আগে রোজার পণ্য আমদানি শুরু হয়। প্রতি মাসের স্বাভাবিক চাহিদার পাশাপাশি রোজার পণ্যের বেচাকেনাও হয় এ সময়। রোজার সময় ছোলা, মসুর ডাল, মটর ডাল, ভোজ্যতেল ও চিনির চাহিদা বাড়ে। আবার আটা–ময়দার চাহিদা রয়েছে।

আমদানির তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের আড়াই মাসে (জানু–১৫ মার্চ) ছোলা আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৫৭ হাজার টন। গত বছর একই সময়ে ছিল ১ লাখ ৬৫ হাজার টন। এক মাস আগেও ছোলা আমদানিতে যে সংকট ছিল, তা কেটে গেছে ভারত থেকে আমদানি শুরু হওয়ার পর।

ছোলার মতো আমদানি কমেছে মটর ডাল ও মসুর ডালের। মটর ডালের আমদানি ৫০ শতাংশ কমে গেছে। চলতি বছরের আড়াই মাসে (জানু–১৫ মার্চ) মটর ডাল আমদানি হয় ৭৬ হাজার টন। গত বছর একই সময়ে যা ছিল ১ লাখ ৫২ হাজার টন। আবার গত বছর একই সময়ে যেখানে মসুর ডালের আমদানি ছিল ১ লাখ ৪৩ হাজার টন, সেখানে এবার আমদানি হয়েছে ১ লাখ ২১ হাজার টন।

ডালজাতীয় পণ্যের দাম কেন কমছে, তা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন প্রায় ৪৮ বছর ধরে খাতুনগঞ্জে ব্যবসা করে আসা সুমন ট্রেডিংয়ের কর্ণধার সঞ্জয় দেব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুই কারণে ছোলার দাম কমেছে। এক. বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ায় মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। তাতে নিত্যপণ্যের চাহিদা কমে গেছে। আবার ডালজাতীয় পণ্য এবার ভারত থেকে আমদানি হয়েছে। ফলে নতুন করে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে খুব বেশি দুশ্চিন্তা নেই।

আরও পড়ুন

পাইকারিতে কমছে ভোজ্যতেলের দাম

রোজায় সাড়ে তিন লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। চলতি বছরের আড়াই মাসে সয়াবিন তেল আমদানি হয় ১ লাখ ২১ হাজার টন। গত বছর একই সময় আমদানি হয়েছিল ১ লাখ ১৯ হাজার টন।

সয়াবিন তেলের আমদানি বাড়লেও বাজারজাত করা কমেছে। যেমন এ বছরের আড়াই মাসে আমদানি করা সয়াবিন তেল কারখানায় পরিশোধন করে বাজারজাত হয়েছে ১ লাখ ২ হাজার টন। গত বছর একই সময়ে বাজারজাত হয়েছিল ১ লাখ ৯৩ হাজার টন।

পামতেলের আমদানিও কম। এ বছর আড়াই মাসে পামতেল আমদানি হয় ২ লাখ ৩৩ হাজার টন। গত বছর ছিল ২ লাখ ৪৮ হাজার টন। একইভাবে গত বছরের তুলনায় পাম তেল বাজারজাত করা কমেছে। বাজারজাত কমলেও চাহিদা কমায় সমস্যা হয়নি।

বাজার পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে খাতুনগঞ্জের আরএম এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার শাহেদ উল আলম প্রথম আলোকে বলেন, পাইকারি বাজারে সয়াবিন তেল ও পাম তেলের দাম কমতির দিকে। ১০ দিনের ব্যবধানে সয়াবিনের দাম পাঁচ টাকা এবং পাম তেলের দাম চার টাকা কমেছে।

আরও পড়ুন

বাড়তি দামে আটকে আছে চিনি–আটা–ময়দা

গত বছর থেকে চিনি আমদানি কমছিল। এ বছর আড়াই মাসে চিনি আমদানি হয়েছে ৪ লাখ ৪১ হাজার টন। গত বছর একই সময়ে ছিল ৮ লাখ ৫৯ হাজার টন। কয়েক মাস ধরে বাজারে চিনির সরবরাহ কমেছে।

তবে চাহিদা কমায় বড় ধরনের সংকট হয়নি বলে ব্যবসায়ীরা জানান। যেমন গত আড়াই মাসে চিনি পরিশোধন করে বাজারজাত হয়েছে ৪ লাখ ৩৫ হাজার টন। গত বছর একই সময়ে বাজারজাত হয়েছিল ৬ লাখ ২৯ হাজার টন। বাজারজাতের এই চিত্রের অর্থ হলো মানুষ এখন চিনি কম খাচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারিতে চিনির দাম এক দফা বাড়ানো হয়। এরপর থেকে বাজারে প্রতি কেজি ১১৫ থেকে ১২০ টাকায় চিনি বিক্রি হচ্ছে। সরকার চিনিতে শুল্ককর কমালেও তার প্রভাব পড়েনি বাজারে।

বাজারে আটার দাম অনেক দিন ধরেই বাড়তি। আমদানিও কম। এ বছরের আড়াই মাসে গম আমদানি হয় ৯ লাখ ২৩ হাজার টন। গত বছর একই সময়ে আমদানি ছিল ১২ লাখ ৩৬ হাজার টন। অবশ্য দাম বাড়ার পর আটার দাম স্থিতিশীল আছে।

খেজুরের দাম বাড়তি

খেজুর আমদানিও সামান্য কমেছে। এ বছর আড়াই মাসে খেজুর আমদানি হয় ৩৫ হাজার টন। গত বছর একই সময়ে ছিল ৩৭ হাজার টন। রোজার আগেই বাজারে খেজুরের দাম বেড়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি চলে ইরাকের জাহিদি খেজুর। পাইকারি বাজারে কেজিতে এই খেজুর ১০ টাকা বেড়েছে। তবে দামি খেজুর, বিশেষ করে আজওয়া কেজিপ্রতি ১০০ টাকা বেড়েছে।

জানতে চাইলে খেজুর আমদানিকারক ফারুক ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মূলত বিশ্ববাজারে খেজুরের দাম বেড়েছে। আবার দেশে ডলারের দামও বেড়েছে। এ দুটির প্রভাব পড়েছে খেজুরের বাজারে।

আরও পড়ুন

তদারকি বাড়াতে হবে

বাজার পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে খাদ্যপণ্যের চাহিদায়ও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। রোজার পণ্যের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। এরপরও আমদানি যেহেতু কম, সে জন্য সরবরাহ কোথাও যাতে ব্যাহত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাজারে অপ্রত্যাশিত দাম যাতে না বাড়ে, সে জন্য তদারকিও বাড়াতে হবে।