চিনির সংকট, দামও বাড়ল

দুই মাসে দ্বিতীয়বার দাম বাড়ানোর ঘোষণা, রোজার দুই মাস বাকি, সরবরাহ বাড়ছে না।

বাজারে চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়তি। ফলে চাপ বাড়ছে টিসিবির দোকানগুলোয়। পণ্য পেতে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষকে। গতকাল দুপুরে, রাজধানীর জুরাইন রেলগেট এলাকায়।
ছবি: সৈয়দ জাকির হোসেন

প্রায় পাঁচ–ছয় মাস ধরে চিনির বাজারে সংকট কাটছে না। ডলার–সংকটে আমদানি কমেছে। ডলারের দাম বাড়ায় আমদানিব্যয় ও করভার বাড়ছে। গ্যাস–বিদ্যুতের দাম বাড়ায় উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে। তাতে বাজারে কোথাও কোথাও চিনির দেখা মিলছে না। এমন সংকটের মধ্যেই আবার দাম বাড়ানোর ঘোষণা এল।

গতকাল চিনি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন প্রতি কেজিতে পাঁচ টাকা বাড়িয়ে প্যাকেটজাত চিনির দাম ১১২ টাকা নির্ধারণের কথা জানিয়েছে। খোলা চিনির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১০৭ টাকা। তবে বাজারে সংকটের অজুহাতে গতকালও চট্টগ্রামে খোলা চিনি ১১০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি ১১২–১১৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ টিসিবির হিসাবে ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়।

আরও পড়ুন

গত বছরের জুলাই–আগস্ট থেকে চিনির বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। এ অবস্থায় গত সেপ্টেম্বরে সরকার প্রথমবারের মতো চিনির দাম বেঁধে দেয়। এরপর অক্টোবর ও নভেম্বরে দুই দফা দাম বাড়ানো হয়। গতকালসহ তিন দফায় প্রতি কেজি ২৩ টাকা দাম বাড়ছে চিনির। আর এমন সময়ে চিনির দাম বাড়ার ঘোষণা এল যখন রোজা শুরু হতে মাত্র দুই মাস বাকি। রোজায় কম দামে চিনি কেনার স্বস্তি উধাও হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব গোলাম রহমান এ নিয়ে গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, চিনির বাজারে একের পর এক সংকট লেগে থাকলেও সুরাহা হচ্ছে না। চিনি উৎপাদনে গ্যাস–বিদ্যুতের সংকট কিছুটা কাটিয়ে উঠলেও এখন দাম বাড়ানোর কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। ডলার–সংকটে ঋণপত্র খুলতে সমস্যা কাটেনি। খালাসেও বিলম্ব হচ্ছে। ডলারের দাম বাড়ায় শুল্কও বেড়েছে। এ কারণে নতুন দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্তের কথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জানিয়ে দিয়েছি আমরা। এভাবে খরচ বেড়ে যাওয়ায় দাম না বাড়ালে চিনিশিল্প টিকবে না।

আরও পড়ুন

সংকট কাটছেই না

দেশে চিনির বাজারে আছে মাত্র পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। যেমন সিটি, মেঘনা, এস আলম, দেশবন্ধু ও আবদুল মোনেম লিমিটেড। এসব প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে কারখানায় পরিশোধনের পর বাজারজাত করে। সরাসরি পরিশোধিত চিনি আমদানি করে খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। বছরে কমবেশি ২১ লাখ টন চিনি আমদানি হয়। দেশে উৎপাদিত হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টন। অর্থাৎ চিনির বাজার পুরোপুরি আমদানির ওপর নির্ভরশীল।

উদ্যোক্তা ও বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চার কারণে চিনির বাজারে অস্থিরতা কাটছে না। এক. ঋণপত্র খুলতে না পারায় চিনি আমদানি হচ্ছে কম। আবার ঋণপত্রের জটিলতায় বন্দরে আসা চিনির চালান খালাসে বিলম্ব হচ্ছে। তাতে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে গেছে। দুই. বিশ্ববাজারেও চিনির দাম বাড়তি। তিন. ডলারের বিনিময়হার বাড়ায় গাণিতিক হারে শুল্ককরও বেড়েছে। চার. গ্যাস–বিদ্যুৎ–সংকট কিছুটা কাটিয়ে উঠলেও নতুন করে দাম বাড়ানোর কারণে উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে।

আরও পড়ুন

দেশে এখন প্রতি মাসে গড়ে পৌনে দুই লাখ টনের কমবেশি চিনির চাহিদা রয়েছে। তবে চলতি অর্থবছর থেকে ঋণপত্র–সংকটে চিনি আমদানি কমে গেছে। যেমন গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই থেকে ২৫ জানুয়ারি) চিনি আমদানি হয়েছে ১১ লাখ ৬৩ হাজার টন। এবার একই সময়ে আমদানি ৮ লাখ ৭৩ হাজার টন। আমদানি করা চিনির মধ্যে দেড় লাখ টনের বেশি এখনো বন্দরে ভাসছে। ঋণপত্রের জটিলতায় খালাসে বিলম্ব হচ্ছে।

সংকটের সময় আমদানি করা চিনি যখন কারখানায় নেওয়া হচ্ছে, তখন উৎপাদনেও হিমশিম খাচ্ছেন উৎপাদকেরা। কারখানায় গ্যাস–বিদ্যুতের সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সম্প্রতি এই সংকট কিছুটা কমলেও গ্যাস–বিদ্যুতের দাম বাড়ায় প্রতি কেজি চিনিতে দুই টাকা বাড়তি খরচ হবে বলে দাবি তাদের।

বিশ্ববাবাজরে চিনির দাম গত বছরের শেষ দিক থেকে বাড়ছে। ব্যবসায়ীরা গতকাল যখন চিনির দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেন, তখন বিশ্ববাজারে প্রায় ২ শতাংশ বেড়েছে চিনির দাম। যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য লেনদেনের বাজার শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডের (সিবিওটি) তথ্য অনুযায়ী, গত ১৭ মাসের মধ্যে এখন চিনির দাম সর্বোচ্চ। মার্চে সরবরাহ হবে এমন চিনি গতকাল লেনদেন হয়েছে প্রতি পাউন্ড ২০ দশমিক ৪৬ সেন্টে। টনপ্রতি দাম পড়ে ৪৫১ ডলার। এই দামের সঙ্গে জাহাজভাড়া, বিমাসহ আনুষাঙ্গিক খরচ যুক্ত হবে। চার মাস আগে এই দাম ছিল ৬২ ডলার কম, টনপ্রতি ৩৮৯ ডলার।

চিনির বাজারে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। ডলারের দাম বাড়ার কারণে টাকায় একদিকে আমদানি খরচ বেড়েছে। অন্যদিকে ডলারের বাড়তি বিনিময়মূল্য ধরে কাস্টমস শুল্কায়ন করছে। তাতে শতাংশ হারে কয়েক মাসের ব্যবধানে শুল্ককরও বেড়েছে প্রতি কেজিতে সাত থেকে আট টাকা।

জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের বিনিময়মূল্য বাড়ায় প্রতি কেজিতে করভার ৩০ শতাংশ বেড়েছে। নতুন দামে যেসব চিনি খালাস হচ্ছে, সেগুলোতে এখন প্রতি কেজিতে ৩০–৩২ টাকা শুল্ককর দিতে হচ্ছে।

সরবরাহ বাড়ানো জরুরি

সামনে রোজা আসছে। সময় আছে দুই মাস। এ সময়ে চিনির সরবরাহও কম। এ পরিস্থিতিতে করণীয় কী জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চিনির দাম বাড়ায় মানুষের ওপর চাপ বাড়বে। চাপ কমানোর জন্য শুল্ক সমন্বয়, বাজারে সরবরাহ বাড়াতে যেসব সমস্যা রয়েছে তা দূর করা এবং কেউ কৃত্রিম সংকট বা কারসাজি করছে কি–না, তাতে নজরদারি বাড়ানো দরকার। ডলার–সংকটে বন্দরে যেসব চিনি খালাসে বিলম্ব হচ্ছে, তা দ্রুত সমাধান করলে বাজারে চিনির সরবরাহ বাড়বে।