দেশীয় শিল্প বিকাশে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য

সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত
ফাইল ছবি

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে যতজন ভালো অর্থনীতিবিদ আমরা পেয়েছি, মুহিত সাহেব তাঁদের মধ্যে অন্যতম। অর্থনীতির ছাত্র না হয়েও তিনি ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশের অর্থনীতির আজকের শক্তিশালী অবস্থা ও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ঈর্ষণীয় যে প্রবৃদ্ধি, তার পেছনে মুহিত ভাইয়ের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল, তিনি ছিলেন অসম্ভব ধৈর্যশীল একজন শ্রোতা। মনোযোগ দিয়ে সবার কথা শুনতেন, পাল্টা প্রশ্ন করে সবকিছু বুঝতে চাইতেন। আর কোনো একটি বিষয়ে যদি তাঁকে যুক্তি দিয়ে ভালোভাবে বোঝানো যেত, তাহলে তিনি তা অবশ্যই করতেন।

আমি যখন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি, তখন প্রতিটি বাজেটের আগে ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন বিষয়ে তিনি আমাদের ডাকতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাদের কথা শুনতেন। এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি থাকার সময় একবার তাঁর সঙ্গে আমার ১২টায় একটি বৈঠকের সময় নির্ধারিত ছিল। কিন্তু আমি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ১৫ মিনিট দেরি হয়ে যায়। যখন তাঁর সামনে গেলাম, তখন তিনি কিছুটা রাগত হয়ে বললেন, আপনি সময় মিস করেছেন। আপনার সঙ্গে আজ আর কোনো কথা হবে না। স্বভাবগতভাবে কিছুটা রেগেও গেলেন। পরে অনেক অনুনয়-বিনয় করে তাঁর কাছ থেকে ৫ মিনিট সময় চেয়ে নিই। কিন্তু দেখা গেল, কথা যখন শুরু হলো তখন তিনিই ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে এটা-ওটা জানতে চাইছেন। তাতে ৫ মিনিটের বৈঠক শেষ হয় দেড় ঘণ্টায়।
দেশীয় শিল্পের আজকের যে বিকাশ, তার পেছনে মুহিত সাহেবের অবদান আমরা কেউ অস্বীকার করতে পারব না। আজকে দেশীয় কোম্পানি হিসেবে ওয়ালটনের যে বিকাশ, তার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল মুহিত সাহেবের। তিনি ওয়ালটনসহ দেশীয় কোম্পানির বিকাশের জন্য বাজেটে নানা ধরনের সুবিধা দিয়েছেন। তিনি সব সময় চাইতেন, দেশীয় শিল্পগুলো শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াক। এমনকি ওনার সময়কালে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসকে কেনিয়ায় কারখানা করার অনুমোদন দিয়েছিলেন।

কে আজাদ

তাঁর দেওয়া আর্থিক সহায়তার কারণেই বর্তমানে দেশের প্রায় ৬৪ জেলায় ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনের নিজস্ব ভবন গড়ে উঠেছে। জেলা চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনগুলোর অবকাঠামোসহ নানা উন্নয়নে তিনি এফবিসিসিআইকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেন। এ ছাড়া বস্ত্র, চামড়া, পাট ও পাটজাত পণ্যে নগদ সহায়তা অব্যাহত রাখার তাঁর সিদ্ধান্তের কারণে এ খাতগুলো নানাভাবে উপকৃত হয়েছে। এ সহায়তার কারণে গত প্রায় এক দশকে দেশে বস্ত্র খাতের ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে।

একজন অর্থমন্ত্রীর বাইরে তিনি ছিলেন সদা হাস্য একজন মানবিক মানুষ। ছিলেন শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রেমী। শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষদের তিনি অত্যন্ত স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতেন। ঢাকার সাবেক মেয়র আনিসুল হক যখন মারা যান তখন দেখেছি, কবর দেওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত দুটো মানুষ আনিসুল হকের কবরের পাশে বসে ছিলেন। তাঁদের একজন আবুল মাল আবদুল মুহিত। অন্যজন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় আনিসুল হকের কবরে শেষ পর্যন্ত বসে থাকার এ দৃষ্টান্ত আমাকে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল।

তাঁর অসুস্থতার খবর শুনে আমরা কয়েকজন মিলে তাঁকে তাঁর বাসায় দেখতে গিয়েছিলাম। এ সময় তাঁকে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার অনেক অনুরোধ করি। কিন্তু তিনি রাজি হননি। দেশেই তিনি চিকিৎসা করাবেন বলে জানান। শেষ পর্যন্ত দেশেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। সেই সঙ্গে একজন মানবিক মানুষ ও প্রাজ্ঞজনকে হারালাম আমরা।

সাবেক সভাপতি এফবিসিসিআই