শ্রমবাজারের নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেই

সায়েমা হক, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা পরিচালক, সানেম

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী করোনা ভাইরাসের ফলে বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বস্তুতপক্ষে কোভিড-১৯ এর আগেই বাংলাদেশের শ্রম বাজারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল তরুণদের বেকারত্ব। অর্থনীতির শ্লথগতির কারণে এই চ্যালেঞ্জ আরও জটিল হয়েছে।

অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানে প্রায় ৯০% তরুণ (১৮-২৯ বছরের) নিয়োজিত থাকায়, একদিকে যেমন অনেক তরুণ কাজ হারিয়েছে/ ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে, অপরদিকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার সংকটের কারণে শ্রমবাজারে নতুন করে প্রবেশ করতে চাওয়া তরুণদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

এ ছাড়া বিদেশ থেকে কাজ হারিয়ে ফেরত আসা কিংবা সাময়িকভাবে বিদেশে যেতে না পারা তরুণেরা স্থানীয় বাজারে প্রবেশ করার ফলে শ্রমবাজারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে।

কোভিড-১৯ এর কারণে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক তরুণের জন্যই হয়তো উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ব্যাহত হয়েছে যার ফলে তাদের দক্ষতা ও মানব সম্পদের ক্ষেত্রেও এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে যা তাদের কর্মসংস্থানকে প্রভাবিত করতে পারে।

তবে শুধু বেকারত্ব নয়, কোভিড-১৯ এর কারণে কাজ না হারালেও (অথবা নিজস্ব ব্যবসা বন্ধ না হলেও) অনেকেরই মজুরি/মুনাফা কমে গেছে আবার পেশার পরিবর্তন করে নিম্নআয়ের পেশায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক তরুণই। মধ্যম/দীর্ঘ মেয়াদে করোনা ভাইরাসের ফলে স্পর্শহীন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্ব বাড়বার কারণে ৪র্থ শিল্প-বিপ্লব সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির দক্ষতা না থাকলে চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা আরও বাড়বে।

বিবিএস এর শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ অনুযায়ী মাত্র ৬% তরুণ শ্রমশক্তির উচ্চশিক্ষা (টারসিয়ারী শিক্ষা) রয়েছে এবং সিংহভাগ তরুণেরই প্রযুক্তিগত শিক্ষা নেই। তাই শ্রমবাজারের নতুন চ্যালেঞ্জের জন্য অনেকেরই সঠিক প্রস্তুতি নেই। অপরপক্ষে বেকার তরুণদের ১৩ শতাংশ আবার টারসিয়ারী শিক্ষা রয়েছে তাই শ্রমবাজারে বিদ্যমান দক্ষতার সমন্বয়হীনতা অর্থাৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা ও ডিগ্রির সঙ্গে চাকরিদাতা চাহিদার বড় ধরনের ফারাক থাকার কারণে নতুন কর্মসংস্থান আগে থেকেই চ্যালেঞ্জিং ছিল।

এ ছাড়া মনে রাখতে হবে যে, কোভিড-১৯ এর কারণে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক তরুণের জন্যই হয়তো উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ব্যাহত হয়েছে যার ফলে তাদের দক্ষতা ও মানব সম্পদের ক্ষেত্রেও এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে যা তাদের কর্মসংস্থানকে প্রভাবিত করতে পারে। সার্বিকভাবে, কোভিড-১৯ এর কারণে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার প্রতিবেদনে প্রকাশিত তরুণ বেকারত্বকে মোকাবিলা করতে হলে একদিকে যেমন প্রয়োজন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অন্যদিকে তেমন দরকার ক্ষতিগ্রস্তদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করে তাদের পুনরায় শ্রমবাজারে লাভজনকভাবে সংশ্লিষ্ট করার ব্যবস্থা করা।

আরও পড়ুন

শ্রমবাজারকে পুনরুজ্জীবিত করবার মাধ্যমে তরুণদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হলে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকে চাঙা করা যেমন প্রয়োজন, তেমনি ক্ষুদ্র ও মধ্যম আকারের শিল্প/সেবা খাতের মাধ্যমে তরুণদের স্বনিয়োজিত কাজের সুযোগ করে দেওয়ারও কিন্তু কোনো বিকল্প নেই। কাজ হারিয়ে শহর থেকে যেসব তরুণ গ্রামে ফিরে গেছেন তাদের খামার-বহির্ভূত কৃষি ও কৃষিভিত্তিক ব্যবসায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবার জন্য মূলধনের পাশাপাশি বিপণন ও সাপ্লাই- চেইনকে সুসংহত করা প্রয়োজন। তবে কোভিড-১৯ একদিকে যেমন আয় এবং কর্মসংস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে, সীমিত পরিসরে হলেও বিশেষ করে তরুণদের জন্য নতুন করে কাজের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে অনলাইন ভিত্তিক কর্মকাণ্ড ও ই-কমার্সের সম্প্রসারণের জন্য বিশেষভাবে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা পরিচালক, সানেম