এআই বাড়াচ্ছে কাজের চাপ, চীনের ‘৯৯৬’ সংস্কৃতি কি ফিরছে
একসময় ৭০ ঘণ্টার কর্মসপ্তাহকে বিবেচনা করা হতো অতিরিক্ত পরিশ্রম হিসেবে। এই অতি পরিশ্রমের সংস্কৃতিকে ‘খারাপ’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকাতে এটি আবার নতুন করে ফিরে আসছে। সপ্তাহে ছয় দিন, সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজের কুখ্যাত ‘৯৯৬ মডেল’ আবারও চালু হয়েছে সিলিকন ভ্যালির বেশ কিছু স্টার্টআপে।
ইতিমধ্যেই কয়েকটি এআই কোম্পানি এই কর্মঘণ্টা বাস্তবায়ন করছে। কগনিশন কর্মীদের কাছ থেকে সপ্তাহে ৮০ ঘণ্টা কাজ দাবি করছে বলে জানা গেছে। আর রিলা চাকরিপ্রার্থীদের আগেই সতর্ক করে দিয়ে বলছে, সপ্তাহে প্রায় ৭০ ঘণ্টা কাজের জন্য তাঁরা যেন প্রস্তুত থাকেন। এমনকি গুগলের সহপ্রতিষ্ঠাতা সের্গেই ব্রিনও সম্প্রতি বলেছেন, সপ্তাহে ৬০ ঘণ্টা কাজই উৎপাদনশীলতার জন্য ‘সুইট স্পট’।
এখন বড় প্রশ্ন হলো, এই চরম কর্মসংস্কৃতি কি শুধু স্টার্টআপেই সীমিত থাকবে, নাকি ছড়িয়ে পড়বে করপোরেট জগৎজুড়ে?
চীনের ‘৯৯৬’ সংস্কৃতির উত্থান ও পতন
৯৯৬ হচ্ছে সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সপ্তাহে ছয় দিন (৭০ ঘণ্টা) একনাগাড়ে কাজের সংস্কৃতিকে বোঝায়। একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের গোড়ার দিকে চীনের প্রযুক্তি ও উৎপাদন খাতে ‘৯৯৬ কর্মসংস্কৃতি’ প্রথম শুরু হয়। দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সময় কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যেতে এই মডেল গ্রহণ করে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই এটি নিয়ে নানা সমালোচনা শুরু হয়। চীনের শ্রম আইনে সপ্তাহে ৪৪ ঘণ্টা কাজের সীমা এবং সময়ের অতিরিক্ত কাজে (ওভারটাইম) পারিশ্রমিক বাধ্যতামূলক হলেও অনেক কোম্পানি তা উপেক্ষা করে। এর ফলে বার্নআউট, গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি, এমনকি কর্মীদের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে।
অবশেষে ২০২১ সালে চীনের সর্বোচ্চ আদালত ‘৯৯৬ মডেল’কে অবৈধ ঘোষণা করে। কারণ, এটি কর্মী এবং সমাজের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছিল। এই রায়ের পর অনেক চীনা কোম্পানি টেকসই ও মানবিক কর্মসংস্কৃতির দিকে ঝুঁকতে শুরু করে।
এআই বাড়াচ্ছে মানুষের কাজের চাপ
এআই মূলত কাজকে স্বয়ংক্রিয় ও সহজ করার জন্য তৈরি। কিন্তু সিলিকন ভ্যালিতে ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। এআই দৌড়ে জিততে কর্মীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা।
রিলার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘আপনি যদি সপ্তাহে প্রায় ৭০ ঘণ্টা অফিসে কাজ করতে প্রস্তুত না থাকেন, তাহলে আবেদন করবেন না।’
কোম্পানিগুলো এআইকে দক্ষতা তৈরির হাতিয়ার হিসেবে না দেখে, বরং মানুষকে আরও বেশি কাজ করানোর অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে। এআই খাতে প্রতিযোগিতা এত বেশি বেড়েছে যে কোম্পানিগুলো দ্রুত উদ্ভাবন আনতে কর্মীদের চরম চাপ দিচ্ছে। স্টার্টআপগুলো বলছে, ‘যদি আমরা প্রতিযোগীদের চেয়ে আগে নতুন এআই টুল তৈরি না করি, বাজার হারাব।’
স্টার্টআপ থেকে মূলধারার করপোরেট জগতে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা
সিলিকন ভ্যালির কর্মসংস্কৃতি আগেও ধীরে ধীরে মূলধারার করপোরেট জগতে ছড়িয়েছে। যেমন ওপেন অফিস কনসেপ্ট, আনলিমিটেড পেইড টাইম অফ (PTO) এবং ‘মুভ ফাস্ট অ্যান্ড ব্রেক থিংস’ দর্শন প্রথমে টেক খাত থেকে শুরু হয়ে পরে বড় বড় কোম্পানিতে গিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ৭০ ঘণ্টার কর্মসপ্তাহও একইভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ওয়াল স্ট্রিট, ম্যানেজমেন্ট কনসালটিং, কিংবা বিগ ল (BigLaw)–এর মতো প্রতিযোগিতামূলক খাতগুলো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য এই নীতি গ্রহণ করতে পারে।
মানবিক ক্ষতি
অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার মানবিক ক্ষতি প্রমাণিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, সপ্তাহে ৫৫ ঘণ্টা বা তার বেশি কাজ করলে ৩৫% বেশি স্ট্রোকের ঝুঁকি তৈরি হয় এবং ১৭% বেশি হৃদ্রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। অতিরিক্ত কাজের ফলে কর্মীদের মানসিক ও শারীরিক সক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে যায়, মনোযোগ ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নষ্ট হয় এবং সৃজনশীলতা হ্রাস পায়।
ব্যবসার জন্যও ক্ষতিকর ‘৯৯৬’
কোম্পানিগুলো মনে করতে পারে ৭০ ঘণ্টার কর্মসপ্তাহ উৎপাদনশীলতা বাড়ায়, কিন্তু গবেষণা বলছে, উল্টো কথা। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ জন পেনক্যাভেল দেখিয়েছেন, সপ্তাহে ৫০ ঘণ্টার পর উৎপাদনশীলতা দ্রুত কমতে থাকে। সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টা কাজ করা কর্মীদের উৎপাদন প্রায় ৫৫ ঘণ্টা কাজ করা কর্মীদের সমান অর্থাৎ বাড়তি পরিশ্রম কোনো ফল দেয় না।
কর্মীদের করণীয়: সচেতনতা ও আত্মরক্ষা
এই সংস্কৃতি অর্থাৎ সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টার কর্মসংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ার আগেই কর্মীদের সচেতন হওয়া জরুরি।
১. সতর্ক থাকুন
চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে যদি ‘২৪/৭ উপস্থিতি’ বা ‘অসীম প্রাপ্যতা’–র উল্লেখ থাকে, সাবধান হোন। সাক্ষাৎকারে সরাসরি জিজ্ঞাসা করুন সাপ্তাহিক গড় কাজের সময় ও ওভারটাইম নিয়ে।
২. আইনি অধিকার সম্পর্কে জানুন
আপনি আওয়ারলি (ঘণ্টা অনুযায়ী) নাকি এক্সেম্পট (ওভারটাইম ছাড়া স্থায়ী বেতনভুক্ত) তা বুঝুন।
৩. সীমানা নির্ধারণ করুন
নিজের কাজের সময় নথিবদ্ধ করুন, ছুটি (PTO) অবশ্যই ব্যবহার করুন এবং নিয়মিত কাজের সময়ের বাইরে প্রাপ্যতার বিষয়ে স্পষ্ট যোগাযোগ রাখুন।
দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকার কৌশল: বেশি নয়, স্মার্ট কাজ
চীনের ৯৯৬ অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, অতিরিক্ত কাজ স্বল্প মেয়াদে ফল দিলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা ভালো ফল আনে না। কর্মীর চাকরি ছেড়ে দেওয়া, উৎপাদনশীলতার কমে যাওয়া এবং সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
স্মার্ট কোম্পানিগুলো এখন এআইকে ব্যবহার করছে মানুষের কাজের চাপ কমাতে, যাতে কর্মীরা সৃজনশীল ও কৌশলগত কাজে মনোযোগ দিতে পারে সীমিত ও ভারসাম্যপূর্ণ সময়ের মধ্যে। যেসব প্রতিষ্ঠান ফ্লেক্সিবল কাজের সুযোগ, সত্যিকারের ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্স এবং টেকসই ক্যারিয়ার তৈরি করছে, তাঁরা এখন প্রতিভাবান কর্মী নিয়োগে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পাচ্ছে। তথ্যসূত্র: ফোর্বস