ভবিষ্যতের চাকরিজগৎ ‘রিমোট’ বা ‘হাইব্রিড’ নয়—আসছে ‘মাইক্রোশিফটিং’ যুগ

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওল ল্যাবসের হাইব্রিড ওয়ার্ক প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বেজুড়ে ৬৫ শতাংশ অফিসকর্মী এখন সময়সূচিতে আরও স্বাধীনতা চানছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

সকালের নাশতার সময়ই ল্যাপটপ খুলে অফিসের ই-মেইল চেক করা, দুপুরে সন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া, বিকেলে কাজের ফাঁকে একটু ঘোরাঘুরি আর রাতে আবার বসে রিপোর্ট লেখা। এই ছন্দে কাজের নতুন ধরন ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘মাইক্রোশিফটিং’।

রিমোট বা হাইব্রিড কাজের পরবর্তী ধাপ হিসেবে পরিচিত কর্মপদ্ধতিতে কর্মীরা দিনে একটানা আট ঘণ্টা নয় বরং কয়েক দফায় নিজেদের সুবিধামতো কাজের সময় ভাগ করে নেন। কেউ সকালে দুই ঘণ্টা, কেউ বিকেলে তিন ঘণ্টা, আবার কেউ রাতে কয়েক ঘণ্টা কাজ করেন। এই সময়ের স্বাধীনতাই মাইক্রোশিফটিংয়ের মূল বৈশিষ্ট্য।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওল ল্যাবসের ২০২৫ সালের হাইব্রিড ওয়ার্ক অবস্থা প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বজুড়ে ৬৫ শতাংশ অফিসকর্মী এখন সময়সূচিতে আরও স্বাধীনতা চান। ডেপুটির ‘দ্য বিগ শিফট: যুক্তরাষ্ট্র ২০২৫’ জরিপে দেখা গেছে, মাইক্রোশিফটিং জ্ঞানভিত্তিক কাজে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, বিশেষ করে জেনারেশন জেডের কর্মীরা স্বল্প সময়ের কাজের শিফট বেছে নিয়ে শিক্ষা ও প্রযুক্তিনির্ভর একাধিক দায়িত্বের ভারসাম্য বজায় রাখছেন।

বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্রেও নতুন ছন্দ

বাংলাদেশের কর্মজগতেও মাইক্রোশিফটিংয়ের ছাপ পড়ছে। তরুণ ফ্রিল্যান্সার, আইটি পেশাজীবী, অনলাইন শিক্ষক, ডিজাইনার ও সাংবাদিকেরা দিনের মধ্যে নিজেদের সুবিধামতো কাজের সময় ভাগ করছেন। কেউ রাতজাগা, কেউ ভোরবেলা বেশি মনোযোগী; প্রতিজনের জীবনযাপন ও কাজের ধরন ভিন্ন।

ঢাকার মিরপুরে বসবাসকারী রিমা হক, দুই সন্তানের মা ফ্রিল্যান্স কনটেন্ট রাইটার বলেন, ‘সারা দিন একটানা কাজ করার সময় পাই না। সকালে দুঘণ্টা লিখি, দুপুরে সন্তানদের দেখাশোনা করি, রাতে আবার বসে কাজ করি। এতে কাজও হয়, সংসারও চলে।’ তাঁর মতে মাইক্রোশিফটিংয়ের মূল দর্শন হলো, কাজের মান সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর এখানেই ৯টা থেকে ৫টা অফিসের ধারা প্রশ্নের মুখে পড়ছে।

বিশ্বজুড়ে অফিস সময়ের সীমানা বদলাচ্ছে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মও সেই পরিবর্তনের স্রোতে এগোচ্ছে। অভিজ্ঞ পেশাজীবীরা মনে করছেন, কাজের ধরন পাল্টে যাচ্ছে, কিন্তু কাজ থেমে নেই; শুধু ঘড়িটা বদলে গেছে।

সময়ের হিসাব পাল্টে যাচ্ছে

৯টা থেকে ৫টা অফিসের সময়সূচি শিল্পবিপ্লবের উত্তরাধিকার। কারখানায় শ্রমঘণ্টা মাপার জন্যই এই মডেল তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এখনকার কাজ হচ্ছে মস্তিষ্ক ও সৃজনশীলতার, যেখানে উৎপাদন মাপা হয় আইডিয়া দিয়ে, সময়ের কাঁটায় নয়। তবু অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো কর্মীদের অফিসে ফেরাতে চাইছে।

ওল ল্যাবসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ৬৩ শতাংশ কর্মী পূর্ণকালীন অফিসে ফিরেছেন। কিন্তু একাধিক কর্মী জানাচ্ছেন যে অফিসে উপস্থিত থাকলেই উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত হয় না। বাংলাদেশেও কোভিড-১৯-এর সময় রিমোট কাজের অভিজ্ঞতা অনেককে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। এখন অনেক সংস্থা হাইব্রিড ব্যবস্থায় কাজ করলেও সময়ের স্বাধীনতা এখনো সীমিত। গুলশানের এক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আফরোজা খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার কাজ ডেটা বিশ্লেষণ করা। অফিসে আট ঘণ্টা থাকলেও সব সময় কাজ হয় না। বরং নিজের মতো করে সময় ভাগ করলে ফলাফল ভালো হয়।’

আরও পড়ুন
বাংলাদেশের কর্মজগতেও মাইক্রোশিফটিংয়ের ছাপ পড়ছে। তরুণ ফ্রিল্যান্সার, আইটি পেশাজীবী, অনলাইন শিক্ষক, ডিজাইনার ও সাংবাদিকেরা দিনের মধ্যে নিজেদের সুবিধামতো কাজের সময় ভাগ করছেন
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

বিশ্বজুড়ে কর্মীরা এখন শুধু বেতন বা পদোন্নতি নয়, জীবনের ভারসাম্যকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন। ওল ল্যাবসের জরিপ বলছে, কর্মীরা আরামদায়ক সময়সূচির জন্য গড়ে বার্ষিক বেতনের ৯ শতাংশ ছাড় দিতে রাজি। বাংলাদেশেও চিত্রটা ভিন্ন নয়। অনেকে সকালে সন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে কাজ শুরু করেন, কেউ দুপুরে মা–বাবার ওষুধ কিনে এসে আবার ল্যাপটপে বসেন। জীবন আর কাজের পারস্পরিক বোঝাপড়াই মাইক্রোশিফটিংয়ের মূল শক্তি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) অধ্যাপক রিদওয়ানুল হক বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে মাইক্রোশিফটিং কালচার ইউরোপ ও আমেরিকাজুড়ে বেশ জনপ্রিয়। কোভিডের পর বাংলাদেশেও এই চর্চা শুরু হয়েছে। মাইক্রোশিফটিং ব্যবস্থায় অফিসে অবস্থান করা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং সঠিক সময়ে সঠিকভাবে কাজটি সম্পন্ন করাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রযুক্তির এই উৎকর্ষের যুগে আমাদের দেশে অনেকেই আন্তর্জাতিক সময় অনুযায়ী কাজ করছেন। তাঁদের ক্ষেত্রে মাইক্রোশিফটিং খুব উপযোগী।’

আরও পড়ুন

যত্ন ও দায়িত্বের বাস্তবতা

বিশ্বজুড়ে প্রায় ৬২ শতাংশ কর্মীর ঘরে সন্তান বা প্রবীণ সদস্যের যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব আছে। এতে চিরাচরিত অফিস সময় অসুবিধাজনক হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের ৭১ শতাংশ পূর্ণকালীন অফিসকর্মী মনে করেন যে যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব তাঁদের কর্মদক্ষতায় প্রভাব ফেলে। রিমোট কর্মীদের মধ্যে এই সংখ্যা মাত্র ৪৮ শতাংশ।

বাংলাদেশে বর্তমানে অনেক তরুণ একাধিক কাজ করেন। প্রধান চাকরির পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং, অনলাইন ব্যবসা বা টিউশন। কম্পিউটার সায়েন্সের শিক্ষার্থী সায়েম রহমান বলেন, ‘সকালে ক্লাস, বিকেলে কাজ, এই ছন্দই আমার জন্য সবচেয়ে কার্যকর। অফিসে বসে আট ঘণ্টা থাকলে সেটা সম্ভব হতো না।’ এই প্রজন্মের কাছে কাজ মানে স্বাধীনতা, নিজের ছন্দে দায়িত্ব পালন করা। আর সেই স্বাধীনতাই মাইক্রোশিফটিংয়ের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের আইসিটি খাত, অনলাইন শিক্ষা, ফ্রিল্যান্সিং ও স্টার্টআপ কালচারে মাইক্রোশিফটিংয়ের জন্য বিশাল সম্ভাবনা আছে। সরকার ডিজিটাল কর্মসংস্কৃতিকে উৎসাহ দিচ্ছে। তবে পূর্ণ বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। অবকাঠামোগত দুর্বলতা, স্থিতিশীল ইন্টারনেট, কর্মঘণ্টা নির্ধারণে নীতিমালা ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়গুলো এখনো যথেষ্ট মনোযোগ পায়নি।

তবু তরুণ প্রজন্ম আশাব্যঞ্জক দৃষ্টি রাখছে। তারা মনে করে, কাজ মানে শুধু জীবিকা নয়, জীবনের অংশ। কাজের মানই হবে ভবিষ্যতের পরিচয়।

বিশ্বজুড়ে অফিস সময়ের সীমানা বদলাচ্ছে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মও সেই পরিবর্তনের স্রোতে এগোচ্ছে। অভিজ্ঞ পেশাজীবীরা মনে করছেন, কাজের ধরন পাল্টে যাচ্ছে, কিন্তু কাজ থেমে নেই; শুধু ঘড়িটা বদলে গেছে।