ট্রাফিক সহায়কের খণ্ডকালীন চাকরি, শিক্ষার্থীদের সুবিধার থেকে শঙ্কা বেশি

ট্রাফিক সহায়কের কাজ করছেন এক শিক্ষার্থী। মতিঝিল এলাকা, ঢাকা, ৫ অক্টোবর, ২০২৫ছবি: দীপু মালাকার

বিকেল সাড়ে পাঁচটা। রাজধানীর কারওয়ান বাজার মোড়ে দুজন তরুণ ট্রাফিক সহায়ক দৌড়ে যান একদিকে অটোরিকশা থামাতে, পরক্ষণেই ছুটে যান উল্টো দিক থেকে আসা গাড়ির দিকে। ঢাকার বিশৃঙ্খল রাস্তায় কিছুটা শৃঙ্খলা ফেরানোর চেষ্টা তাঁদের। পাশে রয়েছেন এক ট্রাফিক পুলিশ সদস্যও। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অস্থিরতা দেখা দেয়। তখনই শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে অংশ নেন। পরে অন্তর্বর্তী সরকার ও ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) যৌথ উদ্যোগে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে শিক্ষার্থীদের খণ্ডকালীন ট্রাফিক সহায়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

খণ্ডকালীন চাকরি, কিন্তু অনিশ্চিত সুবিধা

প্রতিদিন চার ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের বিপরীতে শিক্ষার্থীরা পান ৫০০ টাকা। মাসের ৭ তারিখের মধ্যে বেতন দেওয়ার কথা থাকলেও নিয়মিতভাবে বিলম্ব হচ্ছে। জুন ও জুলাই মাসে অনেকে বেতনই পাননি। অনেকেই টিউশনি ছেড়ে এই কাজে আসায় আর্থিক চাপে পড়েছেন। সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুহাম্মদ মিয়ান বলেন, ‘এই শহরের ট্রাফিক সামলানো খুব কঠিন। প্রতি সেকেন্ডে সতর্ক থাকতে হয়। আমরা শুধু আইন মানাতে নয়, পুলিশ ও মানুষের দূরত্ব কমাতেও কাজ করছি। অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণই সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ।’ দায়িত্ব শুরু করার আগে শিক্ষার্থীরা মাত্র এক সপ্তাহের প্রশিক্ষণ ও একটি ভেস্ট পেয়েছেন। আইডি কার্ড এখনো দেওয়া হয়নি। অনেকেই ভবিষ্যতে চাকরির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা সনদ পাওয়ার আশায় এই কাজে যুক্ত হয়েছেন। তবে নিয়মিত বেতন, নিরাপত্তা ও মর্যাদার অভাব শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা তৈরি করেছে।

মতিঝিল এলাকায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছেন শিক্ষার্থীরা
প্রথম আলোর ফাইল ছবি
আরও পড়ুন

দায়িত্ব ও চ্যালেঞ্জের ভার

ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ যেমন ক্লান্তিকর, তেমনি বিপজ্জনকও। যানজট, রোদ, ধুলো আর গরমে কাজ করতে গিয়ে শারীরিকভাবে কষ্ট পেতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। শাহবাগ মোড়ে দায়িত্বরত এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘৫ আগস্টের পর যখন সবাই স্বেচ্ছাসেবক ছিলাম, মানুষ হাততালি দিত। এখন আর সেই সম্মান নেই। উল্টো প্রভাবশালীদের চাপ ও নিরাপত্তাঝুঁকি বেড়েছে।’ নারী ট্রাফিক সহায়কদের অভিজ্ঞতা আরও কঠিন। আনিষা নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘অনেকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে। প্রশ্ন তোলে—মেয়ে হয়ে ট্রাফিকের দায়িত্বে কেন?’ কিছু পুলিশও ভাবেন, আমরা নাকি দায়িত্ব পালনে উপযুক্ত নই। তিনি মনে করেন, নারীদের অংশগ্রহণ থাকলে ট্রাফিক ব্যবস্থায় মানবিকতা বাড়ে, কিন্তু সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো প্রতিবন্ধক।

৫ আগস্টের পর যখন সবাই স্বেচ্ছাসেবক ছিলাম, মানুষ হাততালি দিত। এখন আর সেই সম্মান নেই। উল্টো প্রভাবশালীদের চাপ ও নিরাপত্তাঝুঁকি বেড়েছে।
শাহবাগে দায়িত্বরত শিক্ষার্থী

স্বাস্থ্যঝুঁকি ও শিক্ষা ব্যাহত

ট্রাফিক সহায়কদের চার ঘণ্টার দায়িত্ব প্রায়ই দীর্ঘায়িত হয়। ফলে পড়াশোনা, বিশ্রাম ও ব্যক্তিগত জীবনে সময়ের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ধুলো, ধোঁয়া ও শব্দদূষণের কারণে অনেকে ডাস্ট অ্যালার্জি, পিঠব্যথা ও মানসিক চাপের শিকার হচ্ছেন। আবিদ হাসান নামে এক প্রাক্তন ট্রাফিক সহায়ক বলেন, ‘প্রথমদিকে সমস্যা হয়নি। মাসখানেক পর ডাস্ট অ্যালার্জি ও মাথাব্যথায় ভুগি। পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছিলাম না, তাই চাকরি ছেড়ে দিই।’

ট্রাফিক সহায়কদের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে: ডিএমপি

বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ৮৭০ জন শিক্ষার্থী ট্রাফিক সহায়ক হিসেবে কাজ করছেন। ডিএমপির যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. আনিছুর রহমান বলেন,‘ট্রাফিক সহায়কদের কারণে আমাদের কাজে সুবিধা হচ্ছে। তাদের কাজে বহাল রাখা প্রয়োজন। সাধারণ মানুষকে সচেতন করা ও ট্রাফিক পুলিশের প্রতি আস্থা তৈরিতেও কাজ করছে তারা। তাদের কিছু সমস্যার মধ্যেও পড়তে হচ্ছে, তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি যাতে তাদের আইডি কার্ড এবং অনিয়মিত বেতনের মতো সমস্যাগুলো দ্রুত নিরসন করা যায়।’

অনেকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে। প্রশ্ন তোলে—মেয়ে হয়ে ট্রাফিকের দায়িত্বে কেন?’
আনিষা, শিক্ষার্থী

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই খণ্ডকালীন চাকরির সুযোগ দরকার

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভেতরেই খণ্ডকালীন চাকরির ব্যবস্থা থাকলে শিক্ষার্থীদের জন্য তা বেশি উপযোগী হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মাসউদ ইমরান প্রথম আলোকে বলেন,‘বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে গবেষণা সহকারী, শিক্ষণ সহকারী, লাইব্রেরি বা আইটি কাজের সুযোগ থাকলে শিক্ষার্থীরা নিরাপদে কাজ করতে পারবে। এতে আর্থিক সুবিধার পাশাপাশি বাস্তব অভিজ্ঞতাও অর্জন হবে।’

রাজধানীর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা প্রশংসনীয় হলেও তাঁদের খণ্ডকালীন চাকরি কতটা স্থায়ী ও নিরাপদ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ক্লান্তি, স্বাস্থ্যঝুঁকি, অনিশ্চয়তা আর দেরিতে বেতন—এই বাস্তবতায় অনেকেই ভাবছেন, এই চাকরি কি সত্যিই সহায়তা করছে, নাকি শিক্ষার্থীদের নতুন করে চাপে ফেলছে?

আরও পড়ুন