চীনে উচ্চশিক্ষা: আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য আসছে বড় পরিবর্তন

২০২৬ সাল থেকে বছরে পাঁচবার জানুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল, জুন ও ডিসেম্বর মাসে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবেফাইল ছবি

চীনে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের স্নাতকপর্যায়ের ভর্তিপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে দেশটির সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করেছে ‘চায়না স্কলাস্টিক কম্পিটেন্সি অ্যাসেসমেন্ট-সিএসসিএ’ পরীক্ষা।

চীনের একাধিক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চিত করেছে যে ২০২৬ সালের ভর্তিপ্রক্রিয়া থেকে এই পরীক্ষার ফলাফল হবে স্নাতকপর্যায়ের আবেদনপত্রের বাধ্যতামূলক অংশ। এই সিদ্ধান্তকে চীনের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার ‘গেম-চেঞ্জার’ বলা হচ্ছে। কারণ, এটি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা যাচাইয়ের একটি একক, নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে কাজ করবে। এ ছাড়া এই উদ্যোগ ‘স্টাডি ইন চায়না’ ব্র্যান্ডকে আরও শক্তিশালী করবে এবং ভর্তিপ্রক্রিয়ায় ন্যায্যতা ও গুণগত মান নিশ্চিত করবে।

আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের স্নাতক পর্যায়ের ভর্তি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে চীন চালু করেছে ‘চায়না স্কলাস্টিক কম্পিটেন্সি অ্যাসেসমেন্ট (CSCA)’ পরীক্ষা
ছবি: লেখকের পাঠানো

প্রথমবারের মতো ২০২৫ সালের ২১ ডিসেম্বর এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে, যা বৈশ্বিকভাবে প্রথম সিএসসিএ পরীক্ষা। এর আগে ২০২৫ সালের ১২ অক্টোবর চীনা সরকারি বৃত্তি পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে এই পরীক্ষা নেওয়া হয়। চীনা কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৬ সাল থেকে চীনা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, বিশেষ করে যেগুলো চায়নিজ গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ-সিএসসি–এর আওতায় শিক্ষার্থী নেয়, তারা প্রথমে এই পরীক্ষার ফলাফল বাধ্যতামূলক করবে এবং ২০২৮ সাল থেকে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ইচ্ছুক সব শিক্ষার্থীর জন্য ক্রমান্বয়ে বাধ্যতামূলক করা হবে বলে পরিকল্পনা রয়েছে।

পরীক্ষা হবে মূলত অনলাইনে। পাশাপাশি ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে অফলাইন কেন্দ্রেও পরীক্ষার সুযোগ থাকবে। ২০২৬ সাল থেকে বছরে পাঁচবার জানুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল, জুন ও ডিসেম্বরে এ পরীক্ষা হবে।

সিএসসিএ পরীক্ষা বৃত্তান্ত

সিএসসিএ পরীক্ষায় মোট চারটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে, বিশেষায়িত চীনা ভাষা, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন। পরীক্ষার কাঠামো শিক্ষার্থীর নির্বাচিত বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হবে। বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে আবেদনকারীদের জন্য নির্ধারিত হয়েছে চীনা ভাষা, গণিত এবং প্রোগ্রামভেদে পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়ন। অন্যদিকে, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য থাকবে চীনা ভাষা ও গণিত বিষয়ে পরীক্ষা। গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন প্রতিটি বিষয়ের প্রশ্নপত্রে থাকবে ৪৮টি বহুনির্বাচনী প্রশ্ন, যার সময়সীমা নির্ধারিত এক ঘণ্টা। আর চায়নিজ অংশে থাকবে ১০০টি প্রশ্ন, যার উত্তর দিতে সময় পাওয়া যাবে এক ঘণ্টা ত্রিশ মিনিট। পরীক্ষার মাধ্যম হবে চীনা ও ইংরেজি ভাষা, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠ্য ভাষা অনুযায়ী বেছে নিতে পারে। চীনা ভাষায় পাঠদানভিত্তিক প্রোগ্রামে আবেদনকারীদের সংশ্লিষ্ট ‘স্পেশালাইজড চায়নিজ’ পরীক্ষা দিতে হবে, তবে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। এই কাঠামোর মাধ্যমে আবেদনকারীদের একাডেমিক প্রস্তুতি ও প্রোগ্রামভিত্তিক দক্ষতা যাচাই করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

প্রথম দফায় পরীক্ষা হবে মূলত অনলাইনে, পাশাপাশি ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে স্থাপিত অফলাইন কেন্দ্রেও পরীক্ষার সুযোগ থাকবে। ২০২৬ সাল থেকে বছরে পাঁচবার জানুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল, জুন ও ডিসেম্বর মাসে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জন্য মূলত এপ্রিল, জুন ও ডিসেম্বরের সেশন আর ইউরোপ ও আমেরিকার জন্য জানুয়ারি ও মার্চের সেশনগুলো বরাদ্দ থাকবে, যাতে বিভিন্ন টাইমজোনের শিক্ষার্থীরা সুবিধামতো সময় বেছে নিতে পারে।

আরও পড়ুন

সিএসসিএ পরীক্ষার ফি নির্ধারিত হয়েছে এক বিষয়ের জন্য ৪৫০ ইউয়ান, দুই বা ততোধিক বিষয়ের জন্য ৭০০ ইউয়ান। পরীক্ষার জন্য নিবন্ধন শুরু হবে ২০২৫ সালের নভেম্বর মাসে এবং এটি করতে হবে সিএসসিএ’র অফিসিয়াল ওয়েবসাইট এর মাধ্যমে, যেখানে চীনা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই ফর্ম পূরণের ব্যবস্থা থাকবে। পরীক্ষা পরিচালনা করবে চায়না স্কলারশিপ কাউন্সিল (সিএসসি)। প্রতিটি বিষয়ের স্কোর ১০০ নম্বরের মধ্যে হবে। ফলাফল প্রকাশ করা হবে অনলাইন পরীক্ষার ক্ষেত্রে সাত কর্মদিবসের মধ্যে এবং পেপার-বেজড পরীক্ষার ক্ষেত্রে ১৪ কর্মদিবসের মধ্যে। স্কোরের মানদণ্ড ও সর্বনিম্ন যোগ্যতা নম্বর এখনো নির্ধারিত হয়নি। এটি পরীক্ষার ট্রায়াল রানের পর ঘোষণা করা হবে এবং সব বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিজস্ব ভর্তি নির্দেশিকা ও ন্যূনতম স্কোর নির্ধারণ করবে।

প্রথমবারের মতো ২০২৫ সালের ২১ ডিসেম্বর এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে, যা বৈশ্বিকভাবে প্রথম সিএসসিএ পরীক্ষা
ছবি: লেখকের পাঠানো

চীনে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, বিশেষত ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’–এর অংশীদার দেশগুলো থেকে। আগে ভর্তির জন্য বিভিন্ন দেশের শিক্ষাগত মানের পার্থক্যের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা যাচাই করতে সমস্যায় পড়ত। সিএসসিএ চালুর মাধ্যমে সরকার চায় ভর্তিপ্রক্রিয়াকে একক, ন্যায্য ও স্বচ্ছ করা হোক। একই সঙ্গে এটি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের একাডেমিক দক্ষতা যাচাইয়ের একটি মানসম্মত সূচক হবে, যা চীনের বৈশ্বিক শিক্ষা আকর্ষণ বাড়াবে।

আরও পড়ুন

২০২৬ সালের আবেদনকারীদের জন্য এই পরীক্ষা বাধ্যতামূলক হওয়ায় এখন থেকেই পরিকল্পনা করা জরুরি। শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে নিয়মিত আপডেট দেখা, আবেদন করার আগে দেখে নেওয়া পছন্দের প্রোগ্রাম সিএসসিএ স্কোর চায় কি না, প্রোগ্রামভিত্তিক বিষয় ও নম্বরের চাহিদা বুঝে নেওয়া এবং প্রস্তুতি শুরু করা অন্তত কয়েক মাস আগে থেকেই। এ পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করলে শিক্ষার্থীরা সরকারি স্কলারশিপ ও প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পাবে।

সিএসসিএ শুধু একটি পরীক্ষা নয়, বরং এটি চীনের উচ্চশিক্ষাকে বৈশ্বিক মানে উন্নীত করার অংশ। এই পরীক্ষার মাধ্যমে চীন নিশ্চিত করতে চায় যে যারা চীনে এসে পড়াশোনা করছে তারা সত্যিই একাডেমিকভাবে প্রস্তুত এবং চীনের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে সক্ষম। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিতব্য সিএসসিএ পরীক্ষা হবে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। চীনে পড়াশোনার স্বপ্ন দেখা শিক্ষার্থীদের জন্য এখন সময় এসেছে নতুন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার। সিএসসিএ পরীক্ষার মাধ্যমে একদিকে ভর্তিপ্রক্রিয়া আরও প্রতিযোগিতামূলক হবে, অন্যদিকে এটি শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতির মানও উন্নত করবে। তাই এখন থেকেই প্রস্তুতি শুরু করাটা বুদ্ধিমানের কাজ; কারণ, ২০২৬ সালের ভর্তি মৌসুমে চীনের আন্তর্জাতিক শিক্ষাজগতে এই নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন