চাকরিতে আবেদনের ফি বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?

প্রতীকী ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

চাকরিতে আবেদনের খরচও বাড়াল সরকার। আগে যে টাকায় আবেদন করা যেত, এখন সেই পদগুলোতে আবেদনের ক্ষেত্রে বাড়তি টাকা গুনতে হবে চাকরিপ্রার্থীদের। গতকাল রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এ–সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। তবে সরকার বলছে নতুন প্রজ্ঞাপনে তাঁরা আবেদন ফি বাড়ায়নি, বরং সমন্বয় করেছে।

সরকারি সব চাকরির (ক্যাডার পদ বাদে) আবেদন ফি পুনরায় নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার বলছে, সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, দপ্তর এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরির জন্য এই ফি প্রযোজ্য হবে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ৯ম গ্রেড বা এর বেশি গ্রেডভুক্ত (নন–ক্যাডার) পদে আবেদন ফি ৬০০ টাকা, দশম গ্রেডের পদে আবেদন ফি ৫০০ টাকা, ১১ থেকে ১২তম গ্রেডের জন্য ৩০০ টাকা, ১৩ থেকে ১৬তম গ্রেডের জন্য ২০০ টাকা এবং ১৭ থেকে ২০তম গ্রেডের জন্য ১০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

আগে চাকরিতে আবেদনের ফি–সংক্রান্ত কোনো সুনির্দিষ্ট প্রজ্ঞাপন ছিল না। তবে প্রথম আলো চাকরির অন্তত ২০টি সরকারি বিজ্ঞাপন পর্যালোচনা করেছে। তাতে দেখা গেছে, সরকার চাকরিতে আবেদনের ফি আগের থেকে বাড়িয়েছে।

আরও পড়ুন

আগে নবম ও দশম গ্রেডে একসঙ্গে আবেদন ফি ছিল ৫০০ টাকা। নতুন প্রজ্ঞাপনে নবম ও দশম গ্রেড আলাদা করা হয়েছে। নবম গ্রেড বা এর ওপরের গ্রেডের জন্য আবেদন ফি ৬০০ টাকা নির্ধারণ হয়েছে। তবে ১০ গ্রেডের জন্য ফি ৫০০ টাকাই রাখা হয়েছে। এ ছাড়া নবম গ্রেডের ওপরের গ্রেডের জন্য আগে কোনো ফি নির্ধারিত ছিল না।

আগে ১১ থেকে ১৬তম গ্রেডের জন্য আবেদন ফি একসঙ্গে ছিল ১০০ টাকা। নতুন প্রজ্ঞাপনে ১১ ও ১২তম গ্রেডের জন্য আলাদাভাবে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে ফি বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩০০ টাকা।

১৩ থেকে ১৬তম গ্রেডে আবেদন ফি ছিল ১০০ টাকা। নতুন প্রজ্ঞাপনে সেটি বাড়িয়ে ২০০ টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৭ থেকে ২০তম গ্রেডে আবেদন ফি ছিল ৫০ টাকা। এটি বাড়িয়ে করা হয়েছে ১০০ টাকা।

ছবি: প্রথম আলো

ফি বাড়িয়ে যা বলছে অর্থ মন্ত্রণালয়

চাকরিতে আবেদনের ফি নির্দিষ্ট করার কাজটি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় বলছে তাঁরা ফি নতুন করে বাড়ায়নি বরং সমন্বয় করেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, এটা ঠিক আবেদন ফি বাড়ানো নয়। সমন্বয় করা হয়েছে। আগে নবম ও দশম গ্রেডের আবেদন ফি একসঙ্গে ৫০০ টাকা ছিল। এখন সেটি আলাদা নবম গ্রেডের ক্ষেত্রে ৬০০ টাকা এবং দশম গ্রেডের ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, চাকরির আবেদন ফি সরকারের আয়ের উৎস নয়। আবেদন ফি নেওয়ার ক্ষেত্রে সব প্রতিষ্ঠানকে একটা কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা আমাদের লক্ষ্য। প্রজ্ঞাপনে যেসব প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তারা যেন এটা মানে সে ব্যবস্থা করা হবে।

আবেদনে ফি নির্ধারণে নেই সমন্বয়

১৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখা যায়, নবম ও দশম গ্রেডের পদের জন্য আবেদন ফি চাওয়া হয়েছে ৭০০ টাকা। গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) নবম ও দশম গ্রেডের আটটি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। প্রতিটি পদে আবেদন ফি ১ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছিল। আবার ২০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত বাংলা একাডেমির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ২০তম গ্রেডের জন্য আবেদন ফি চাওয়া হয়েছে ৪০০ টাকা।

তরুণদের কাঁধে নতুন খরচের বোঝা

এই শিক্ষিত বেকারদের একটি বড় অংশ অনেক পদে একসঙ্গে বিভিন্ন পদের সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে আবেদন করে থাকেন। তরুণেরা বলছেন, নতুন করে চাকরির পরীক্ষার আবেদন ফি বাড়ানো তাঁদের ওপর বাড়তি বোঝা। এতে তাঁদের খরচের পাল্লা আরও ভারী হবে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জরিপে উঠে এসেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার থাকছেন। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান।

সরকারি চাকরিতে আবেদন করছেন ও চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এমনই একজন তরুণ সাব্বির হোসেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন। সাব্বির হোসেন বলেন, যেভাবে চাকরিতে আবেদনের ফি বাড়ানো হলো তাতে প্রতিটি পদেই এখন আবেদন ফি বেড়ে গেল। বেকরদের জন্য এটি বাড়তি বোঝা। কোথায় সরকার আবেদনের ফি কমাবে, তা না করে বাড়িয়ে দেওয়ায় আমাদের ওপর চাপ বেড়ে যাবে।

চাকরিতে আবেদনের ফি বাড়ায় খরচ বাড়বে চাকরীপ্রত্যাশীদের
ছবি: প্রথম আলো ফাইল ছবি

আরেক চাকরিপ্রার্থী শান্ত মিয়া। তিনি সরকারি তিতুমীর কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন। তিনি বলেন, সরকার আবেদন ফি না বাড়িয়ে কমিয়ে দিতে পারত। তবে জেলা বা উপজেলাভিত্তিক চাকরির পরীক্ষা নিলে আমাদের খরচ আরও কিছুটা কমে আসত। এতে আমাদের মতো বেকারদের যাতায়াত, থাকা ও খাওয়ার মতো খরচগুলো কমিয়ে ফেলা যেত।

চাকরিপ্রার্থীদের আবেদনের ফি কোথায় যায়?

চাকরিপ্রার্থীদের আবেদনের ফি থেকে পাওয়া অর্থদের একটি বড় অংশ পরীক্ষা ব্যবস্থাপনায় খরচ হয়। এ খরচের মধ্যে রয়েছে, কেন্দ্র ভাড়া, পরীক্ষকদের ভাতা, প্রশ্ন প্রণয়ন, খাতা দেখা ও ফল প্রকাশ করা।

চাকরি পরীক্ষা নেওয়ার কাজে যুক্ত এমন একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একেকটি কেন্দ্রে আড়াই থেকে পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়ে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের। একটি কেন্দ্রে যদি ১০০ রুম থাকে তাহলে সেখানে ২০০ থেকে ২৫০ জন শিক্ষক প্রয়োজন। এ ছাড়া তাঁদের ফরমায়েস খাটার জন্য আরও ৫০ জন অফিস সহায়ক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী প্রয়োজন। ছুটির দিনে যেহেতু পরীক্ষা হয়, তাই শিক্ষকদের এক থেকে দেড় হাজার টাকা। অফিস সহায়ক ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের গড়ে ৫০০ টাকা দিতে হয়। প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের ১০ থেকে ১৫ হাজার ও উপপ্রধানদের ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা দিতে হয়। এ ছাড়া পরীক্ষা কমিটি,  প্রশ্ন কর্তা ও প্রশ্ন বিশেষজ্ঞদের ১ থেকে দেড় লাখ টাকা দিতে হয়। লিখিত পরীক্ষা বা এমসিকিউ শিট তৈরিতে একটা খরচ আছে। এগুলো মূল্যায়নের জন্য খরচ দিতে হয়। মৌখিক পরীক্ষার পরীক্ষকদের সম্মানী ও নাশতা বা দুপুরের খাওয়া বাবদ আলাদা খরচ তো আছেই।

আবেদন ফি বৃদ্ধি কতটা যৌক্তিক?

দেশের সরকারি ব্যাংকগুলোতে নিয়োগের দায়িত্বে থাকা ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি সচিবালয়ের সাবেক মহাব্যবস্থাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. মোশাররফ হোসেন খান মনে করেন নতুনভাবে চাকরিপ্রার্থীদের আবেদন ফি বৃদ্ধি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। তিনি বলেন, পরীক্ষার্থী বেশি হলে তাঁদের পেছনে প্রতিষ্ঠানের খরচ কম হয়। আমরা যখন ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা নিয়েছি, তখন লাখ লাখ প্রার্থীর পরীক্ষা নিয়েছি। তাতে দেখা গেছে পরীক্ষার্থী কম হলে খরচ বাড়ে। যেমন দুজন চিকিৎসক নেওয়া বা একজন প্রকৌশলী নেওয়ার পরীক্ষায় প্রার্থী থাকত কম। হয়তো একটি কেন্দ্রেই সম্পন্ন করা যেত। সেখানে একজনের খরচ আর ১০ জনের খরচ একই। কিন্তু বেশি প্রার্থী হলে বেশি কেন্দ্র হলে পরীক্ষার্থী প্রতি খরচটা অনেকটাই কমে যেত। সে ক্ষেত্রে যেসব বড় নিয়োগ সেখানে সরকার ১৫০ থেকে ২০০ টাকা নিতে পারত। এটা নিয়েও সব খরচ কমানো যেত। আমি মনে করি নতুন আবেদন ফি পুনর্বিবেচনা করা উচিত।