৪৭তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষা: সময় কম, প্রস্তুতি হবে কীভাবে

প্রথম আলো ফাইল ছবি

আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে পারে ৪৭তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষা। বিগত বিসিএস পরীক্ষাগুলোর মধ্যে এবারই প্রার্থীরা লিখিত প্রস্তুতির জন্য সবচেয়ে কম সময় পেতে যাচ্ছেন। স্বল্প সময়ে লিখিত প্রস্তুতি গুছিয়ে নেওয়ার কৌশলগুলো জানাচ্ছেন ৪৪তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট পদে সুপারিশপ্রাপ্ত নাঈম আকবর প্রসূন।

পিএসসির রোডম্যাপ অনুযায়ী নভেম্বর মাসেই ৪৭তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তিন ধাপের বিসিএস পরীক্ষার মধ্যে লিখিত পরীক্ষা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ; কারণ এখানে সিলেবাস ব্যাপক এবং নম্বর বেশি। তবে এবারের পরিস্থিতি আলাদা; প্রার্থীদের হাতে প্রস্তুতির সময় আগের তুলনায় কম। তাই সময় ব্যবস্থাপনা ও কৌশল জরুরি; শুধু পরিশ্রম নয়, নির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করে কাজ করতে হবে।

ইংরেজি (২০০ নম্বর): প্রতিদিন লিখতে হবে

ইংরেজি: অনেক প্রার্থীই এটাকে সবচেয়ে কঠিন মনে করেন। এই বিষয়টি মোট ২০০ নম্বরে দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম অংশে (কম্প্রিহেনশন, ব্যাকরণ, সারাংশ, লেটার টু এডিটর) মোট ১০০ নম্বর। এখানে তুলনামূলক বেশি নম্বর তুলতে পারেন, যদি নিয়মিত অনুশীলন করেন। দ্বিতীয় অংশে (বাংলা-ইংলিশ অনুবাদ ২৫, ইংলিশ-বাংলা অনুবাদ ২৫, ইংরেজি রচনা ৫০)। ফ্রিহ্যান্ড রাইটিং নিয়মিত চর্চা করতে হবে।

কীভাবে পড়বেন—

• প্রতিদিন ইংরেজি জাতীয় পত্রিকার সম্পাদকীয় মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। এতে ভোকাবুলারি ও ভাব প্রকাশের শক্তি দুটোই বাড়ে।

• দৈনিক কমপক্ষে এক ঘণ্টা লিখুন। যেমন কোনো একটি বিষয়ের ওপর ইংরেজিতে ১৫০-২৫০ শব্দের প্যারাগ্রাফ লিখে দেখুন; পর্যালোচনা করে ভুলগুলো ঠিক করুন।

• ব্যাকরণ: প্রতিদিন একটি করে টপিক (উদাহরণ: ভোকাবুলারি—অংশিকুলার শব্দ, টেন্স, কনজাংকশন, প্রিপোজিশন, কম্পোজিট সিরিয়াল) ঝালিয়ে নিন— ব্যাকরণিক নির্ভুলতা বাড়বে।

• প্রথম অংশ: ২ ঘণ্টা বরাদ্দ রাখুন। পুরো প্যাসেজটা প্রথমে মনোযোগ দিয়ে পড়বেন; এরপর ব্যাকরণ ও প্রশ্নোত্তর প্রথমে ১ ঘণ্টা ২০ মিনিটের মধ্যে উত্তর দিন—শেষ ৪০ মিনিটে সামারি ও লেটার লিখুন। এতে রিডিং ও রিপ্লাইয়ের গতি ঠিক থাকে।

• দ্বিতীয় অংশ: এখানেও ২ ঘণ্টা বরাদ্দ রাখুন; রচনার জন্য সর্বশেষ ১ ঘণ্টা রাখুন। অনুবাদের জন্য প্যাসেজ সম্পূর্ণভাবে পড়ে নিন, ভাব বুঝে অনুবাদ করুন। আক্ষরিক অনুবাদ নয়; ভাবানুবাদ অনুশীলন করুন।

৪৭তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। এখন লিখিত পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে শিক্ষার্থীদের
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

বাংলাদেশ বিষয়াবলি (২০০ নম্বর): প্রয়োজন বিশ্লেষণমুখী দক্ষতা

বাংলাদেশ বিষয়াবলি বিস্তৃত—মোট ১৬টি টপিক দিয়ে গঠিত। অতীতে যেসব প্রশ্ন এসেছে সেগুলো বিশ্লেষণ করে বুঝুন কোন বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে—মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান, অর্থনীতি, উন্নয়ন কার্যক্রম, ভৌগোলিক পরিচিতি, জনসংখ্যা, পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি প্রশ্নের উৎস। এখানে তথ্য মুখস্থ করার চেয়ে বিশ্লেষণধর্মী লেখা ও ধারাবাহিক উপস্থাপন বেশি মূল্যবান।

কী করবেন:

• গত কয়েক বছরের প্রশ্নপত্রগুলো বিশ্লেষণ করুন। প্রতিটি বিষয় থেকে কোন ধরনের প্রশ্ন আসে, তা নোট করুন।

• উত্তর লিখুন: প্রতিটি প্রশ্নের শুরুতে সংক্ষিপ্ত ভূমিকা, মূল অংশে বিশ্লেষণ ও শেষে সংক্ষেপে উপসংহার দিন। পয়েন্ট আকারে লেখার অভ্যাস থাকলে ভালো। হাতের লেখা সুন্দর হওয়ার চেয়ে অক্ষরগুলো স্পষ্ট হওয়া জরুরি।

• ম্যাপ স্কেচ করার অভ্যাস রাখুন। উত্তরে ম্যাপ দিতে পারলে ভালো কিন্তু স্পষ্ট হতে হবে।

• কোটেশন প্রয়োজনে ব্যবহার করুন; উপাত্ত দিলে ভালো, তবে ভুল উপাত্ত দেবেন না। ভুল হলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

• মোট ১০টি প্রশ্নের জন্য ৪ ঘণ্টা বরাদ্দ থাকবে; প্রথম পাঁচটি প্রশ্ন দুই ঘণ্টার মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য রাখুন। শক্ত বিষয়গুলো আগে লিখে ফেলুন।

• হাতের লেখা পরিষ্কার রাখুন। অক্ষর স্পষ্ট হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। উত্তরপত্রে কাটাকাটি কম রাখুন; পরিচ্ছন্নতা পরীক্ষকের মনোযোগ টানে।

আরও পড়ুন

বাংলা (২০০ নম্বর): ব্যাকরণে ভালো করতে হবে

বাংলায় প্রায় সব প্রার্থীই ভালো নম্বর তোলার আশা রাখেন। কিন্তু সফলতার চাবিকাঠি হলো প্রথম অংশে শক্ত ভিত্তি তৈরি করা। প্রথম অংশে (ব্যাকরণ ৩০, সাহিত্য ৩০, সারাংশ ২০, ভাবসম্প্রসারণ ২০) ভালো করতে নিয়মিত ব্যাকরণ ও সাহিত্য পড়তে হবে। দ্বিতীয় অংশে (বঙ্গানুবাদ ১৫, চিঠি/প্রতিবেদন ১৫, সংলাপ ১৫, গ্রন্থ সমালোচনা ১৫, প্রবন্ধ ৪০) নির্দিষ্ট ফরম্যাট ও লেখা-চর্চা জরুরি।

কীভাবে প্রস্তুত হবেন:

• ব্যাকরণে বোর্ড-বই অনুসরণ করুন এবং নিয়মিত ব্যাকরণ টপিক সমাধান করুন।

• সাহিত্য: আধুনিক ও প্রাচীন দুটো বিষয়েই ধারণা রাখুন; তবে গ্রন্থ সমালোচনায় নির্দিষ্ট ফরম্যাট মেনে অনুশীলন করলে সুবিধা হয়।

• ভাব সম্প্রসারণ ও রচনার জন্য প্রতিদিন কিছু লেখার অভ্যাস রাখুন; ফ্রি-হ্যান্ড রাইটিংয়ে দক্ষ হলে রচনায় আপনি এগিয়ে থাকবেন।

• বঙ্গানুবাদ ও অনুবাদচর্চার জন্য প্রতিদিন অনুবাদ চর্চা করুন—এখানে ভাবানুবাদ গুরুত্বপূর্ণ, আক্ষরিক অনুবাদ নয়।

• প্রথম অংশ—১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট (প্রথম ১ ঘণ্টা ২০ মিনিটে সাহিত্য, ব্যাকরণ ও সারাংশ; পরবর্তী ২০ মিনিট ভাবসম্প্রসারণ)।

• দ্বিতীয় অংশ—২ ঘণ্টা ২০ মিনিট (রচনার জন্য শেষ ১ ঘণ্টা আলাদা রাখুন)।

• প্রশ্নটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন, উত্তর শুরু করুন—সারাংশে হুবহু লাইন কপি করবেন না; নিজের ভাষায় লিখুন।

বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে শিক্ষার্থীদের
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা (১০০ নম্বর): প্রতিদিন চর্চা ছাড়া সফলতা মিলবে না

গাণিতিক যুক্তি (৫০ নম্বর) ও মানসিক দক্ষতা (৫০ নম্বর): এই অংশে ধারাবাহিক অনুশীলনই সাফল্যের মূল।

• গাণিতিক যুক্তিতে পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, পরিমিতি—নিয়মিত অনুশীলন করা দরকার। তুলনামূলকভাবে গণিতে দুর্বল প্রার্থীদের প্রতিদিন দুই থেকে তিন ঘণ্টা নির্দিষ্ট করে অনুশীলন রাখতেই হবে।

• মানসিক দক্ষতা: এর জন্য নিয়মিত OMR শিটে সময়চর্চা ও মক টেস্ট জরুরি। এখানে সময় ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য। প্রাথমিকভাবে সহজ সমস্যা আগে করে কঠিনগুলো পরে করার অভ্যাস রাখুন। মনে রাখবেন, গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা বিষয়ে আপনি বেশি বেশি চর্চা করে খুব ভালো করতে পারবেন। ফুল মার্কস প্রাপ্তির সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে, যা আপনার কাঙ্ক্ষিত ক্যাডার প্রাপ্তির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য এই ১০০ নম্বরের প্রস্তুতিতে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না।

• গাণিতিক অংশে খাতায় প্রয়োজনীয় জ্যামিতিক ফিগার দিন।

• প্রতিদিন বিভিন্ন স্তরের প্রশ্ন সংগ্রহ করে অনুশীলন করুন—অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও বই—দুটোই ব্যবহার করুন।

আরও পড়ুন

আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি (১০০ নম্বর): কনসেপচুয়াল ও এমপিরিক্যাল ব্যালান্স

আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির প্রশ্নগুলো কনসেপচুয়াল ও এমপিরিক্যাল—উভয় অংশেই মনোযোগী হতে হবে। কনসেপ্ট অংশে (৪০ নম্বর) সংজ্ঞা স্পষ্ট ও ব্যাখ্যা শক্ত হওয়া জরুরি; এমপিরিক্যাল অংশে (৪৫ নম্বর) সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত করে বিশ্লেষণ দেবেন—এখানে সংবাদপত্রের আন্তর্জাতিক কলাম নিয়মিত পড়া অপরিহার্য। সমস্যা সমাধান/নীতিপত্র অংশে (১৫ নম্বর) নির্দিষ্ট ফরম্যাটে লিখতে শিখুন।

• মোট ৩ ঘণ্টার মধ্যে প্রথম ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট কনসেপ্ট ও এমপিরিক্যাল অংশের জন্য বরাদ্দ রাখুন। এমপিরিক্যাল অংশে ম্যাপ ও প্রাসঙ্গিক উদাহরণ ব্যবহার করতে হবে।

সাধারণ বিজ্ঞান, কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি (১০০ নম্বর): মৌলিক ধারণা থাকতে হবে

সাধারণ বিজ্ঞানের (৬০ নম্বর) প্রস্তুতিতে নবম-দশম শ্রেণির বইগুলো ও স্ট্যান্ডার্ড রেফারেন্স পড়া কার্যকর। এখানে বর্ণনামূলক উত্তর হলে প্রাসঙ্গিক চিত্র/ফ্লো চার্ট দিলে আরও স্পষ্টতা পাওয়া যায়। কম্পিউটার (২৫ নম্বর) ও তথ্যপ্রযুক্তিতে (১৫ নম্বর) পঠন তালিকা অনুসরণ করে টপিক ধরে ধরে বারবার আসা প্রশ্নগুলো চিহ্নিত করুন। তথ্যপ্রযুক্তির জন্য অনলাইনে টপিক খুঁজে দেখে নিলে ভালো ফল পাবেন।

• বিজ্ঞান অংশে মোট ৩ ঘণ্টা; দ্রুত লেখার দক্ষতা প্রয়োজন।

• কম্পিউটার অংশের জন্য ২৫ নম্বর বরাদ্দ। প্রকৌশলী মুজিবুর রহমান স্যারের কম্পিউটারবিষয়ক একটি বোর্ড বই আছে, ওই বই অনুসরণ করতে পারেন। সাধারণত ১০টি প্রশ্নের উত্তর করতে হয়, তাই টু দ্য পয়েন্টে উত্তর করতে হবে। পার্থক্যগুলো ছক আকারে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। বিগত বছরের প্রশ্নগুলো ভালোমতো বিশ্লেষণ করতে হবে, এই অংশে ভালো নম্বর তোলা সম্ভব। ২ ঘণ্টার পরবর্তী আধা ঘণ্টার মধ্যে কম্পিউটার অংশ লেখার চেষ্টা করবেন।

• তথ্যপ্রযুক্তি অংশের জন্য ১৫ নম্বর বরাদ্দ এবং শেষ ত্রিশ মিনিটে উত্তর করার চেষ্টা করবেন। বিগত বছরের প্রশ্ন বিশ্লেষণ করলে বুঝতে পারবেন যে এই অংশে প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি হয়।

আরও পড়ুন

পরীক্ষার দিন: শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি

লিখিত পরীক্ষা অনেকটা ম্যারাথন দৌড়ের মতো। জেনারেল ক্যাডারের ৯০০ নম্বরের জন্য আপনাকে পরীক্ষা হলে মোট ২১ ঘণ্টা অংশগ্রহণ করতে হতে পারে; মাঝখানে সময় তেমন পাওয়া যায় না। তাই শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা অপরিহার্য। পরীক্ষার আগের দিন পর্যাপ্ত বিশ্রাম, হালকা ব্যায়াম ও মন শান্ত রাখার অভ্যাস রাখুন।

• দীর্ঘ সময় পড়াশোনার পর শরীর ও চোখের বিশ্রামের জন্য নিয়মিত বিরতি নিন। ১৫-২০ মিনিট পর হাঁটাহাঁটি করলে রক্তসঞ্চালন বাড়ে এবং মন সতেজ থাকে।

• নিয়মিত সময়মতো খাওয়া ও হাইড্রেশন বজায় রাখুন।

যে প্রস্তুতি-পরিকল্পনাই অনুসরণ করুন, আত্মবিশ্বাস বজায় রাখা সবচেয়ে জরুরি। ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক অনুশীলন আপনার মানসিক শান্তি বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখুন—শরীর ও মন সুস্থ থাকলে পরীক্ষায় আপনার পারফরম্যান্স ভালো হবে। হাতে সময় কম, কিন্তু সঠিক কৌশল জানা থাকলে আপনি গুছিয়ে প্রস্তুতি নিতে পারবেন। রোডম্যাপ বানান, প্রতিদিন নিয়মিত লেখালেখি ও অনুশীলন চালান, সময় ভাগ করে পড়ুন এবং মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকুন।

*লিখিত পরীক্ষার পরীক্ষার্থীদের জন্য আমার শুভকামনা রইল।

আরও পড়ুন