করোনা আতঙ্ক আর শাহানার নতুন জীবন

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

শাহানার দীর্ঘ প্রবাসজীবনে এই প্রথম একনাগাড়ে এত লম্বা ছুটি। সপ্তাহের ৬ দিন কাজ গত ১৮ বছর ছিল এ রুটিন। ভোর ৪টায় উঠে স্বামী, বাচ্চাদের টিফিন রেডি করে নিজের ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ তৈরি করেন। স্বামী, বাচ্চাদের ঘুমে রেখেই কাজের উদ্দেশ্যে যাত্রা। সারা দিন কাজ শেষে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে বিছানায় একটু বিশ্রাম নিয়ে রান্নাবান্না, বাচ্চাদের হোমওয়ার্ক করিয়ে তাদের খাইয়ে, নিজে খেয়ে ঘুম। আবার ভোরে ওঠা। কাজে যাওয়া, এটাই তার জীবন। শাহানার যান্ত্রিক জীবন, প্রবাসের জীবন, স্বপ্নের জীবন। বাচ্চাদের বা স্বামীকে খুব একটা সময় দেওয়া হয় না।

রোববার ছুটির দিন একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠে সারা সপ্তাহের বাজার, কাপড় লন্ড্রি করা, রান্নাবান্না আর ঘর গোছাতেই দিন সাবাড়। কাজের ব্রেক টাইমে শাহানা মাঝেমধ্যে ভাবেন, বিয়ের আগের ভাবনা আর পরের বাস্তবতায় কত ফারাক। ইচ্ছা ছিল ছেলেমেয়েরা একটু বাংলা শিখবে, গানবাজনা, কবিতা আবৃত্তি করবে। বাচ্চারা এখন বাংলার চেয়ে ইংরেজিতে কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। প্রথম দিকে শাহানা বাধা দিতেন, এখন আর কিছু বলেন না।

শাহানা দিনের শিফটে আর তাঁর স্বামী রাতের শিফটে কাজ করেন। তাই একে অপরের সঙ্গে রোববার ছাড়া আর দেখা বা কথা হয় না। সুখে–দুঃখে এভাবেই চলে যাচ্ছিল শাহানার দিনগুলো। কিন্তু হঠাৎ এক অদৃশ্য ভাইরাসের আক্রমণে থমকে দাঁড়িয়েছে সারা পৃথিবী। সবাই আতঙ্কিত, বিপর্যস্ত জনজীবন। শাহানাও এর বাইরে নন।

গত ১৫ মার্চ থেকে শাহানার অফিস বন্ধ। ওখানে (কারখানা) তিনি মেশিন অপারেটরের কাজ করতেন। স্বামী কাজ করতেন এক রেস্তোরাঁয়, সেটাও বন্ধ। বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ। সবাই এখন বাড়িতে। এমনটা আগে কখনো হয়নি, তাই বাচ্চাদের মধ্যে কী যে আনন্দ, খুশির বন্যা তাদের মধ্যে। যেন ঘুমন্ত একটা বাড়ি হঠাৎ প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠল। শাহানাও আপ্লুত, আনন্দিত। তাঁর কল্পলোকের ভাবনাগুলো যে বর্তমান। শাহানা ভাবেন, মাঝেমধ্যে পরিবর্তনেরও প্রয়োজন, তাতে মানুষ বুঝতে পারবে কিসের এত ব্যস্ততা, কেন এত ব্যস্ততা, কার জন্য এত ব্যস্ততা? কেন এই আলেয়ার পেছনে ছোটা?

শাহানা বাড়িতে তাঁর ছেলেমেয়ে নিয়ে এ করোনা আতঙ্কের দিনগুলো ভালোই কাটাচ্ছেন। কিন্তু সদা হাস্যময়, বাকপটু, মিশুক স্বভাবের তাঁর স্বামী এখন খুবই চিন্তিত, বিমর্ষ। প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা কথা বলেন না। পৃথিবীর সব চিন্তা যেন তাঁর মাথায় ভর করেছে। মাঝেমধ্যে তাঁর দেশের, প্রবাসের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে করোনা–উত্তর সমাজ, সংসার কী হবে, তা নিয়ে ফোনে কথা বলেন। স্টক মার্কেটে তিনি কিছু বিনিয়োগ করেছিলেন, সেটার সূচক নিচের দিকে। বেতন থেকে প্রতি মাসে ফোর ওয়ান কেতে যে অর্থ জমা করেছিলেন, গত কয়েক বছর তার অবস্থাও নিম্নমুখী। তাই শাহানার স্বামীর মনমেজাজ ভালো না।

শাহানা অবশ্য স্বামীর পুরো বিপরীত। কী রান্না করলেন, কী খেলেন, সারা দিন বাচ্চাদের সঙ্গে কেমন কাটল, ফেসবুকে কে কী পোস্ট দিলেন—এ নিয়ে বান্ধবীদের সঙ্গে ফোনে আলাপ।

শাহানা ভাবেন, চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে স্বামী, ছেলেমেয়েদের সময় দিয়ে আনন্দ–উল্লাসে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু যখনই মনে হলো, বাড়ির মর্টগেজ, বাড়ির ইনস্যুরেন্স, গাড়ির পেমেন্ট, গাড়ির ইনস্যুরেন্স, পানির বিল, কারেন্ট বিল, গ্যাসের বিল, হিটের বিল, ক্রেডিট কার্ডের বিল উপরন্তু দেশে ছোট বোনের বিয়ে ঠিক, বিয়েতেও তাকে একটা বড় অ্যামাউন্ট দিতে হবে। তাঁর স্বামীর পক্ষে একা এত ঘানি টানা সম্ভব নয়। তাঁকেও স্বামীর সঙ্গে সংসারের হাল ধরতে হবে। এসব এলোমেলো চিন্তার মধ্যে ছোট মেয়েটা কোথা থেকে পুরোনো একটা অ্যালবাম নিয়ে এসে তাঁর সামনে ধরে। পুরোনো দিনের ছবি, কলেজের বান্ধবী, পাড়ার খালা, মেজ আপার বিয়ের ছবি, মা–বাবার ছবি। ফিরে যান অতীতে। মনটা আবার সতেজ হয়ে ওঠে। বছরের ছয় মাস মিশিগানের আকাশ থাকে মেঘাচ্ছন্ন। আজ অনেক দিন পর মিশিগানে সূর্য উঠেছে। হ্যামট্রাম্যাক শহরের ইভালিন স্ট্রিটের বাড়ির জানালা ভেদ করে সূর্যালোকের ছোট এক রশ্মি এসে পড়েছে শাহানার মুখমণ্ডলে। শাহানার স্বামী আবিষ্কার করলেন, কেমন যেন একটা স্বর্গীয় আভা খেলা করছে শাহানার সারা শরীরে। ২০ বছরের দাম্পত্য জীবনে কখনো এমন করে দেখেননি শাহানাকে। শাহানার স্বামী ক্ষণিকের মধ্যেই সবকিছু ভুলে ডুবে যান শাহানায়।