শুধু আয় নয়, খরচেও নজর

বার্ষিক আয় তিন লাখ টাকা হলেই আপনাকে সারা বছরের খরচের ফর্দ নিয়ে বসতে হবে। বার্ষিক আয়কর বিবরণীর সঙ্গে ব্যয় বিবরণীর আলাদা ফরম পূরণ করে জমা দিতে হবে। বিদেশ গিয়ে কত খরচ করলেন, সন্তানের দামি স্কুলের বেতন কত দিলেন, বিয়ে-জন্মদিনসহ নানা পার্টি আয়োজনে খরচ কত হলো, গাড়িতে গেল কত টাকা, এমনকি গৃহকর্মীর বেতন দিলেন কত টাকা, তাও হিসাবে আনতে হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নজর এখন করদাতার খরচে।
বেশি আয় করলে বেশি খরচ করবেন-এটাই স্বাভাবিক। এই জীবনযাত্রার ব্যয় বিবরণী দেখেই আপনার সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করা হয়। আয়কর নথিতেই একজন করদাতার আয় ও খরচের চিত্র পাওয়া যায়। হয়তো করদাতা ছোট চাকরি করেন, বেতন-ভাতাও কম। অবৈধভাবে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন, বিলাসবহুল জীবন যাপন করেন। কর ফাঁকি দিতে খরচের বিবরণীতে অনেকে এসব তুলে ধরেন না। তখন এনবিআর বাস্তবের জীবনযাত্রা দেখে আয়-ব্যয়ের উৎস সম্পর্কে তল্লাশি চালাতে পারে।

তবে বার্ষিক রিটার্ন জমাকারীদের বেশির ভাগই খরচের বিবরণী দিতে বাধ্য থাকেন। ৪০ লাখ কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীর (টিআইএনধারী) মধ্যে প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ লাখ করদাতা বার্ষিক রিটার্ন জমা দেন। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, রিটার্ন জমাকারীদের মধ্যে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশের খরচের বিবরণ দিতে হয়েছে। বাড়িভাড়া, চিকিৎসা খরচ, রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন খাতে কর ছাড়ের সীমা বাদ দিয়ে এই বিপুলসংখ্যক করদাতার বার্ষিক আয় ৩ লাখ টাকা পেরিয়ে গেছে।
করদাতার সম্পদের পরিমাণ ২৫ লাখ টাকার বেশি হলে খরচ বিবরণীর পাশাপাশি সম্পদ বিবরণীও দিতে হবে। সম্পদের মূল্য কীভাবে নির্ধারণ করা হবে। জমি, বাড়ির মতো স্থাবর সম্পদের ক্রয়মূল্য দিয়ে তা নির্ধারণ করা হবে। এ ছাড়া কারও কাছে যদি ব্যাংকে এফডিআর ও নগদ টাকা থাকে, তাও সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। অনেক করদাতা কর নথিতে ব্যাংক হিসাবের পরিবর্তে ‘হাতে থাকা নগদ’ অর্থ বা ক্যাশ ইন হ্যান্ড দেখিয়ে থাকেন। সেটাও সম্পদের অংশ।
খরচ বিবরণী সম্পর্কে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, জীবনযাত্রার খরচ দেখাটা ভালো উদ্যোগ। এতে কর ফাঁকির প্রবণতা কমে যাবে। তবে আয়কর বিবরণীর ফরমগুলো আরও সহজ করা উচিত। তিনি বলেন, খরচের বিবরণী নিয়েই এনবিআরকে বসে থাকলে হবে না। কেননা, অনেকে খরচের বিবরণীতে সঠিক চিত্র তুলে ধরেন না। অবৈধ আয় দেখাতে পারেন না।
এবার আসা যাক, বার্ষিক খরচের বিবরণীতে কী ধরনের তথ্য দিতে হয়। এ জন্য এনবিআরের এক পৃষ্ঠার ‘১০ বিবি’ ফরম আছে। ওই ফরমে ১৩ ধরনের খরচ দেখাতে হয়। প্রথমেই করদাতার খাদ্য, বস্ত্র ও অন্য নিত্যপণ্যে ১২ মাসে খরচ কত হলো, সেটা লিখতে হবে।

>

খরচের হিসাব দিতে হবে
বছরে তিন লাখ টাকা আয় হলে খরচ বিবরণী বাধ্যতামূলক
বাড়িভাড়া, সন্তানের স্কুল-কলেজের টিউশন ফি, গৃহকর্মী-গাড়িচালকের বেতন, ডিশ লাইনের ভাড়া, বিদেশ ভ্রমণে ক্রেডিট কার্ডের ব্যয় জানাতে হবে

বাড়ি-গাড়ি
বাড়িভাড়ার খরচও দেখাতে হবে। বাড়িভাড়া উল্লেখ করলেই আপনি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকেন কি না, তা বেরিয়ে আসবে। অনেকে কম বেতনের চাকরি করেন। কিন্তু গুলশান, বনানী, ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকায় লাখ টাকার ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন। তাহলে ওই করদাতার আয় নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
গাড়ি থাকলেও তা খরচ বিবরণীতে উঠে আসবে। গাড়ির চালকের বেতনের হিসাব দিতে হবে। এর পাশাপাশি জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ কত খরচ করলেন, তাও ফরমে লিখতে হবে। তবে বড় বড় ব্যবসায়ী নিজেদের নামে গাড়ি দেখান না। কোম্পানির পরিচালক বা উদ্যোক্তা হিসেবে এসব খরচ কোম্পানি থেকে নেন। এটি আসলে কর এড়ানোর কৌশল। কোম্পানির খরচের মধ্যে বাড়ি-গাড়ি ঢুকে যায়। এতে করদাতা ও কোম্পানি উভয়ের লাভ।

গৃহস্থালি
আপনার বাড়িতে এক বা একাধিক গৃহকর্মী আছে। মাসে মাসে বেতন দেন। গৃহকর্মীর বেতন বাবদ যে খরচ করেন, তা বছর শেষে এনবিআরকে জানাতে হবে। এ ছাড়া ইন্টারনেট, টেলিভিশন চ্যানেল বা ডিশের লাইনের ভাড়া ও গৃহস্থালির খরচও জানাতে হবে। এমনকি বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস, পানি, পয়োনিষ্কাশনের বিলের রসিদও সংরক্ষণ করবেন। এগুলোর খরচও দেখাতে হবে। প্রতিদিন আপনার বাড়ি থেকে দৈনন্দিন বর্জ্য নিয়ে যায়, এ জন্য মাস শেষে টাকা দিতে হয়। সেটাও কিন্তু গৃহস্থালির খরচ।
শিক্ষা
ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় মধ্যবিত্তের আয়ের একটি বড় অংশ চলে যায়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি, কোচিংয়ের পেছনে মাসে হাজার হাজার টাকা খরচ করেন। তাই সন্তানদের শিক্ষা ব্যয়ের তথ্যও ব্যয় বিবরণীতে দিতে হয়। অনেকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানকে পড়ান। এতে ওই করদাতার বৈধ আয়ের সঙ্গে সন্তানের পড়াশোনা ব্যয়ের মধ্যে অসংগতি থাকলে তা উঠে আসবে।

বিদেশ ভ্রমণ
বছর বছর দেশ-বিদেশ ভ্রমণ শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রায় নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরে কতবার বিদেশ গিয়ে কত খরচ করলেন, তা এখন এনবিআর জানতে চায়। ক্রেডিট কার্ডে হোটেল ভাড়া, কেনাকাটা, বিমানভাড়া দিলেও তা জানাতে হবে। ক্রেডিট কার্ডের হিসাব না দিলে এনবিআর আপনার কার্ডের যাবতীয় হিসাব তলব করতে পারে। তাই নিয়মিত দেশের অভ্যন্তরে কিংবা বিদেশে নিয়মিত যাতায়াত করেন কিংবা দেশের বাইরে ঘুরতে যান, সেই খরচের হিসাব রাখুন।

বিনোদন
ধনীরা এখন রাজধানীর বড় বড় নামীদামি কনভেনশন সেন্টারে ছেলেমেয়েদের বিয়ের অনুষ্ঠান করেন। লাখ লাখ টাকা খরচ করেন। বছর শেষে সেই খরচের ফর্দ নিয়ে বসতে হবে। এনবিআরকে জানাতে হবে যাবতীয় খরচ। উৎসব, পার্টি কিংবা অন্য কোনো আয়োজন করলে এর খরচ বিবরণী দিতে হবে। আবার কাউকে মানবিক সাহায্য করলেন কিংবা স্কুল-কলেজ ও অন্য দাতব্য প্রতিষ্ঠানে অনুদানের খরচও এই খাতের অন্তর্ভুক্ত।

কর
করদাতার দেওয়া করও একধরনের খরচ। এমনকি আপনি যে পদে পদে উৎসে কর দেন, সেটাও খরচ। এসব খরচ ১০ বিবি ফরমে দেখাতে হবে। তা না হলে হিসাব মিলবে না। সব মিলিয়ে বার্ষিক মোট ব্যয় ও কর মিলিয়েই খরচ বিবরণী তৈরি করতে হয়।