হরেক রকম রপ্তানি পণ্য

পোশাক যে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানিপণ্য, এ কথা আজ আর কারও অজানা নয়। কিন্তু আমরা কয়জন জানি যে রপ্তানিঝুড়িতে অল্প পরিচিত বা অপরিচিত অনেক পণ্যও আছে। এসব পণ্য থেকে রপ্তানি আয়ও কম নয়। 

একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টা আঁচ করা যাবে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, বাংলাদেশ থেকে গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭১৬ কোটি টাকার বাইসাইকেল রপ্তানি হয়েছে। মেঘনা গ্রুপ ও প্রাণ-আরএফএল গ্রুপসহ কয়েকটি বড় কারখানা রয়েছে সাইকেল উৎপাদনের। কিন্তু গত অর্থবছর টুপি রপ্তানি হয়েছে সাইকেলের দ্বিগুণেরও বেশি। এই অর্থবছরে ২০ কোটি ৬৫ লাখ ১০ হাজার ডলারের টুপি রপ্তানি হয়েছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ১ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা। 

ঠিক এ রকম প্রধান রপ্তানি পণ্য পোশাকের পাশাপাশি দেশের আনাচকানাচে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে নানামুখী রপ্তানি পণ্যের ছোট ছোট কারখানা। কেউ দেশীয় কাঁচামাল দিয়ে, আবার কেউ বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করে এসব কারখানা গড়ে তুলেছেন। 

কোনো কোনো পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ খুব বেশি নয়, কোনো কোনো পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ আবার বেশ ভালোই। কিছু পণ্য আছে বিশ্ববাজার খুব বড় নয়, আবার কিছু আছে অনেক বড় বাজার, তুলনায় বাংলাদেশ রপ্তানি করছে সামান্যই। কমবেশি যা-ই হোক না কেন, দিন যাচ্ছে আর রপ্তানির ঝুড়িটি বড় হচ্ছে বাংলাদেশের। এতে কর্মসংস্থান যেমন বাড়ছে, অর্জিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রাও। প্রতিবেশী দেশের পাশাপাশি ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকার দেশগুলোতেও যাচ্ছে বাংলাদেশের অপ্রচলিত পণ্য। 

ইপিবির তথ্য অনুযায়ী বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশ পণ্য রপ্তানি থেকে আয় করেছে ৪ হাজার ৫৩ কোটি ডলার বা ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৫৪৭ কোটি ৮৪ হাজার টাকা। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা আরও বেশি ৪ হাজার ৫৫০ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের মোট রপ্তানির ৮৪ শতাংশই পোশাক। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। এ খাতের আয় মোট রপ্তানির মাত্র ২ দশমিক ৫২ শতাংশ। শীর্ষ ১০ রপ্তানি খাতের মধ্যে আরও আছে পাট ও পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য, হালকা প্রকৌশল পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, মৎস্য, ওষুধ ও সিরামিক। 

তাহলে অপ্রচলিত পণ্য থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কত। ইপিবির কাছে এর আলাদা কোনো হিসাব নেই। এ নিয়ে দপ্তরটির ভালো কোনো গবেষণাও নেই। তবে গত অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশের আয় হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার সমান। 

ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান ফাতিমা ইয়াসমিন বলেন, ‘খুবই ভালো দিক যে দেশের আনাচকানাচে অনেক রপ্তানিমুখী পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে, যেগুলো আবার বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। যদি কোনো পণ্যের রপ্তানি সম্ভাবনা দেখা যায়, ইপিবি সেই পণ্যের জন্য গবেষণা করে, নানা সহযোগিতার হাতও বাড়ায়। যেমন রপ্তানিমুখী জাহাজশিল্পের জন্য ইপিবি গবেষণা করেছে।’ 

সাইকেলের চেয়েও টুপি রপ্তানির পরিমাণ বেশি হওয়ার চিত্রটিকে বিশ্বাসযোগ্য মন্তব্য করে ফাতিমা ইয়াসমিন বলেন, ‘দেশে অনেক ধরনের টুপি উৎপাদন হয়। চলতি অর্থবছরে টুপি রপ্তানির পরিমাণ ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলেই আমরা আশা করছি।’ 

পণ্য ও রপ্তানিচিত্র
অপ্রচলিত পণ্যের মধ্যেও কিছু আবার এরই মধ্যে পরিচিত হয়ে গেছে। যেমন আসবাব, বাইসাইকেল, জাহাজ ইত্যাদি। আলু, হস্তশিল্প, কাঁকড়া ও কুঁচিয়া ইত্যাদি পণ্যও রপ্তানি হয় বলে অনেকেই জানেন। 

কিন্তু মানুষ খুব বেশি জানেন না, এমন অপ্রচলিত পণ্যের তালিকাটিই বড়। এগুলো হচ্ছে পরচুলা, গরুর নাড়িভুঁড়ি, চারকোল, টুপি, মাছ ধরার বড়শি, মশারি, শুকনা খাবার, পাঁপড়, হাঁসের পালকের তৈরি পণ্য, লুঙ্গি, কাজুবাদাম, চশমার ফ্রেম, কৃত্রিম ফুল, গলফ শাফট, খেলনা, আগর, ছাতার লাঠি, শাকসবজির বীজ, নারিকেলের ছোবড়া ও খোল দিয়ে তৈরি পণ্য, ব্লেড, ইত্যাদি। এ ধরনের ১০০–এর বেশি পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে বেশ কিছু পণ্য রপ্তানির বিপরীতে ৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকিও দিয়ে থাকে সরকার। 

একদম অপরিচিত পণ্যও রয়েছে এ তালিকায়। যেমন শরীর থেকে রক্ত নেওয়ার পাইপ (ব্লাড টিউবিং সেট), অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই), সি আর কয়েল, তামার তার ইত্যাদি। এসব পণ্যের কারখানা সাধারণত বড় হয়, বিনিয়োগও একটু বেশি। তালিকার অন্য কারখানাগুলো ছোট ছোট। আবার এমন পণ্যও রয়েছে, যার একটিমাত্র কারখানা রয়েছে দেশে। 

ইপিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাজুবাদাম আমদানি করে আবার রপ্তানিও করে বাংলাদেশ। মাঝে প্রক্রিয়াজাত করার পর কিছুটা মূল্য সংযোজিত হয়। রেশম, রাবার, ফেলে দেওয়া কাপড় থেকে তৈরি পণ্য, ভবন নির্মাণসামগ্রী, সিরামিক পণ্য, গ্লাস, তোয়ালে ইত্যাদিও রপ্তানি করা হয়। মসলা আমদানিকারক বাংলাদেশ আবার মসলা রপ্তানিকারকও। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয় উল্লেখ করার মতো প্রসাধনপণ্যও। 

আবার গত অর্থবছরে ৪ কোটি ২৯ লাখ ৩০ হাজার ডলারের কাঁকড়া রপ্তানি হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৩৬৫ কোটি টাকার সমান। এ ছাড়া রপ্তানি হয়েছে ৩ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের তামার তার, ১ কোটি ১৬ লাখ ডলারের গলফ খেলার স্টিক, ৫৪ লাখ ডলারের কৃত্রিম ফুল। 

রপ্তানির পূর্ণাঙ্গ চিত্র ইপিবিতে পাওয়া যায় না। এখনো ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে পরিচালিত হয় বলে রপ্তানিকারকদের কোনো তালিকাও নেই দপ্তরটির কাছে। রপ্তানি ও রপ্তানিকারকদের বিশদ তথ্য রয়েছে বরং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর), যে তথ্য আবার সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য নয়। 

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বহু বছর ধরেই রপ্তানি বহুমুখীকরণের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এর জন্য যথেষ্ট কাজ নেই সরকারের। প্রণোদনা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিও এমনকি খাতভিত্তিক। 

করণীয় কী তাহলে, এমন প্রশ্নের জবাবে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বৈশ্বিক একটি গবেষণায় উঠে আসে যে অপ্রচলিত পণ্যের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের টিকে থাকার গড় বয়স এক বছর, তবে বাংলাদেশে তা ১ বছর ৮ মাস। সে হিসাবে ভালো। আমার পরামর্শ হচ্ছে, সনাতনী রপ্তানি সহায়তা থেকে বের হয়ে উদ্যোক্তাকেন্দ্রিক সহায়তা দিতে হবে। কারণ, এই উদ্যোক্তাদের কারখানাগুলো ক্ষুদ্র খাত হিসেবেও স্বীকৃতি পায়নি। আবার নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে দেনদরবার করার সক্ষমতাও তাদের থাকে না।