ভোগান্তিতে ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক

>
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ি আরোপের পর বেশ কয়েকটি ব্যাংক উবারের বিল পরিশোধে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে।

ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ‘অবৈধ বিদেশি লেনদেন’ বন্ধ করতে গিয়ে পুরো লেনদেনেই কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এ যেন মাথাব্যথা সারাতে পুরো মাথা কেটে ফেলার অবস্থা। আর এ কাজটি করেছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। আর তাতে ভোগান্তিতে পড়েছেন ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীরা। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ি আরোপের পর গতকাল মঙ্গলবার থেকে কার্ডের মাধ্যমে বিদেশি সেবা ও পণ্য কেনাকাটা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে ব্যাংকগুলোর ক্রেডিট কার্ড ব্যবসা। গতকাল থেকে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও ইস্টার্ণ ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে উবারের বিল পরিশোধ সেবা বন্ধ করে দিয়েছে। অন্য ব্যাংকগুলোও একই পথে হাঁটছে।

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মাথার ছোট ফোড়া সারাতে যেন মাথা কেটে ফেলার মতো অবস্থা। এর ফলে দেশের প্রযুক্তি, শিক্ষা, ফ্রিল্যান্সাররা ভোগান্তিতে পড়বেন। আধুনিক যুগে এমন পশ্চাৎমুখী সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আশা করা যায় না।

তবে এ বিষয়ে যোগাযোগ করেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

কেন এমন সিদ্ধান্ত
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্রেডিট কার্ড দিয়ে বিদেশি লেনদেনের ক্ষেত্রে হঠাৎ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ কড়াকড়ি আরোপের পেছনে দুটি ঘটনা রয়েছে। প্রথমত, ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রায় রাইড শেয়ারিং সেবা উবারের যে সেবামাশুল পরিশোধ করা হয়, তা সরাসরি চলে যায় নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে উবারের ব্যাংক হিসাবে। হিসাবটি মার্কিন ডলারে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ক্রেডিট কার্ডে বিদেশি মুদ্রায় বিল পরিশোধের কারণে এ দেশে দেওয়া উবারের সেবার মাশুল চলে যাচ্ছে সরাসরি বিদেশে। 

এ ছাড়া সম্প্রতি এ দেশের বেসরকারি খাতের একটি ব্যাংকের কয়েকজন গ্রাহক ক্রেডিট কার্ড দিয়ে বিদেশের স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ার কেনাবেচার ব্যবসা করছেন। আবার কেউ কেউ লটারিও কিনছেন। এর মাধ্যমে দেশের অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। এসব বিষয় জানতে পেরে তড়িঘড়ি করে গত বৃহস্পতিবার ক্রেডিট কার্ডের বিদেশি লেনদেনে কড়াকড়ি আরোপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

জানতে চাইলে ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্রেডিট কার্ড কোথায় কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তার হিসাব রাখা ব্যাংকগুলোর পক্ষে সম্ভব নয়। এখন কড়াকড়ি আরোপের কারণে ক্রেডিট কার্ড ব্যবসা পিছিয়ে পড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে অন্য উপায়ে অবৈধ লেনদেন বন্ধের উদ্যোগ নিতে পারত।

কীভাবে সমাধান
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, অনলাইনে জুয়া খেলা, বৈদেশিক লেনদেন, বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনাবেচা, ক্রিপ্ট কারেন্সি ও লটারির টিকিট কেনার কাজে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা যাবে না। পাশাপাশি কার্ডে কী ধরনের লেনদেন হচ্ছে, গ্রাহকদের তারও হিসাব রাখতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক আলাদা একটি ফরম পূরণের কথাও বলেছে। এর ফলে এখন থেকে গ্রাহকদের প্রতিটি লেনদেনের জন্য আলাদা হিসাব রাখতে হবে, বাস্তবে যা প্রায় অসম্ভব। 

কার্ড সেবার সঙ্গে জড়িত দেশি-বিদেশি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এভাবে কড়াকড়ি না করে যেসব সেবা অবৈধ, বাংলাদেশ ব্যাংক তার তালিকা করে দিতে পারত। প্রতিটি সেবার জন্য আলাদা মার্চেন্ট ক্যাটাগরি কোড (এমসিসি) রয়েছে। এসব কোড বন্ধ করে দিলেই অবৈধ লেনদেন বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে গণহারে সব লেনদেনের হিসাব নিতে হবে না।

গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন জারি করলেও ১৫ অক্টোবর থেকে বহুজাতিক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক উবারের বিল পরিশোধে ব্যাংকটির ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। তবে অন্য রাইড শেয়ারিং সেবায় ব্যাংকটির ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা যাচ্ছে। আর গতকাল থেকে দেশীয় মালিকানার ইস্টার্ণ ব্যাংকও উবারে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। 

জানতে চাইলে ইস্টার্ণ ব্যাংকের জনসংযোগ প্রধান জিয়াউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কারণ, দেশে সেবা দিয়ে বিদেশি মুদ্রায় বিল পরিশোধ হয়ে আসছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট পর্যন্ত দেশে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ লাখ ৩ হাজার ৪২৭ জন। গত জুনে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে জুন মাসে ২০ লাখ ৮৫ হাজারবার কার্ড ব্যবহৃত হয়েছে। এপ্রিল ও মে মাসে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন ছিল যথাক্রমে ১ হাজার ১০৮ ও ১ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা।

 তথ্যপ্রযুক্তি খাতে প্রতিক্রিয়া
এদিকে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) নেতারা গত সোমবার বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেন। এক বিজ্ঞপ্তিতে সংস্থাটি বলেছে, সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ। প্রতিবছর ফেসবুক, গুগলসহ অন্যান্য বিদেশি অনলাইনে ২ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে বেশ কিছু ব্যাংক কার্ড দিয়ে এ অর্থ পরিশোধ সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছে। আবার ট্রাভেল কোটায় বরাদ্দ ডলার থেকে ডিজিটাল মার্কেটিং খাতে মূল্য পরিশোধের সুযোগও থাকছে না। ফলে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়িক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।