
দেশে কেনাকাটা, এটিএম (অটোমেটেড টেলার মেশিন) বুথ থেকে টাকা তোলাসহ দৈনন্দিন বিভিন্ন আর্থিক লেনদেনে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। আর কমছে নগদ অর্থের লেনদেন। অর্থাৎ আগে যে লেনদেন নগদ টাকায় হতো, তা এখন কার্ডনির্ভর হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে গত এপ্রিলে মোট ৭ হাজার ৮২৬ কোটি টাকার লেনদেন হয়, যা মে মাসে বেড়ে দাঁড়ায় ৭ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। জুনে সেটি এক লাফে ১০ হাজার ২৩ কোটি টাকায় ওঠে। তিন মাসের এই হিসাবের গড় করলে প্রতি মাসে লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ডেবিট কার্ডে মাসে গড়ে ৮ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা এবং ক্রেডিট কার্ডে ৪৪৭ কোটি টাকা লেনদেন হয়। ক্রেডিট কার্ডের লেনদেনের বড় অংশই হয় কেনাকাটায়। আর ডেবিট কার্ডের সর্বোচ্চ ব্যবহার হয় ব্যাংকের বুথ থেকে অর্থ উত্তোলনে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, কার্ডের এসব লেনদেনের সিংহভাগই এখনো শহরকেন্দ্রিক। আর লেনদেনের সিংহভাগই হয় বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ইস্যু করা ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডে।
গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে জমা থাকা অর্থের বিপরীতে যে কার্ডে লেনদেন হয়, সেটি হলো ডেবিট কার্ড। আর ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যাংকই গ্রাহকের হয়ে টাকা পরিশোধ করে। পরে গ্রাহকের কাছ থেকে সেই অর্থ আদায় করা হয়। কার্ডে লেনদেনে গ্রাহকদের উৎসাহিত করতে বিভিন্ন পণ্য-সেবা ক্রয়ে ‘বিশেষ সুবিধা’ দেওয়া হয়। ক্রেডিট কার্ডের ক্ষেত্রে এসব সুবিধা বেশি থাকে।
ট্রান্সকম ইলেকট্রনিকসের বিক্রয় নির্বাহী মাসুম সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ক্রেডিট কার্ডে কেনাকাটার ক্ষেত্রে পণ্যভেদে ৩ থেকে ১২ মাসের কিস্তি সুবিধা থাকে। এ ছাড়া উৎসব উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের পণ্যে নগদ ছাড়ও দেওয়া হয়।
ফ্যাশন হাউস আড়ংয়ের মগবাজার শাখায় গত জুলাই মাসে প্রায় তিন কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে ২ কোটি ৬৪ লাখ টাকার লেনদেনই হয়েছে কার্ডে। বাকি ৩৬ কোটি টাকার লেনদেন নগদে হয়েছে বলে জানান ওই শাখার জ্যেষ্ঠ হিসাব কর্মকর্তা তন্ময় সমাদ্দার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নগদ অর্থের পরিবর্তে দিন দিন কার্ডে লেনদেনের পরিমাণ বাড়ছে। উৎসবকালীন সময়ে কার্ডে লেনদেনের পরিমাণ স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়।
কার্ড সংখ্যা: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত জুন মাস শেষে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯১ লাখ ৩০ হাজার ৮৯৭টি। এর মধ্যে ৮৫ লাখ ৪৭ হাজার ৬৮৮টি ডেবিট কার্ড ও বাকি ৫ লাখ ৮৩ হাজার ২০৯টি ক্রেডিট কার্ড। মে মাসে মোট ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড ছিল ৮৬ লাখ ৫৪ হাজার ৬০০টি। যার মধ্যে ৮১ লাখ ডেবিট ও ৫ লাখ ৬৪ হাজার ক্রেডিট কার্ড। সেই হিসাবে, মে থেকে জুনে অর্থাৎ এক মাসে কার্ড বেড়েছে প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ।
লেনদেনের হিসাব: গত জুন মাসে ক্রেডিট কার্ডে মোট ৪৮৯ কোটি টাকার লেনদেনের মধ্যে কেনাকাটাই হয়েছে ৪২৬ কোটি টাকার। আর নগদে উত্তোলন হয়েছে ৫৩ কোটি টাকা। এর আগে মে মাসে মোট ৪৩৮ কোটির মধ্যে ৩৮১ কোটি টাকা এবং এপ্রিলে ৪১৪ কোটির মধ্যে ৩৬১ কোটি টাকারই লেনদেন হয়েছে কেনাকাটায়।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত জুন মাসে ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে প্রায় ৯ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকার লেনদেন হয়। এর মধ্যে নগদ অর্থ উত্তোলন হয়েছে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। কেনাকাটা হয়েছে ১ হাজার ৩৩ কোটি টাকার। মে মাসে এ কার্ডে মোট ৭ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা এবং এপ্রিলে ৭ হাজার ৪১২ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, দেশের সব জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ব্যাংকগুলোর আধুনিক প্রযুক্তি বা সেবা বিস্তৃত হলে নগদ লেনদেন একেবারেই কমে আসবে। তখন বিভিন্ন ধরনের লেনদেনের বড় অংশই হবে কার্ডে। বর্তমানে শহরকেন্দ্রিক যে কার্ড সেবা রয়েছে, তাতে কেনাকাটা থেকে শুরু করে, বিভিন্ন হোটেল, রেস্তোরাঁ, মেডিকেল বিল পরিশোধসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে কার্ড ব্যবহৃত হচ্ছে।
কার্ডের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় নগদ অর্থের ঝুঁকি কমছে। সে জন্য দোকানপাট থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এখন নগদ অর্থের পরিবর্তে কার্ডে লেনদেনে বেশি আগ্রহী।
বেসরকারি দি সিটি ব্যাংকের কার্ড বিভাগের প্রধান মাজহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের ব্যাংকের তিন কোম্পানির ডেবিট কার্ড ও দুই কোম্পানির ক্রেডিট কার্ড রয়েছে। তাঁদের ক্রেডিট কার্ডে বছরে গড়ে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ও ডেবিট কার্ডে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়।
মাজহারুল ইসলাম আরও বলেন, আমেরিকান এক্সপ্রেস কার্ডের সর্বশেষ আন্তর্জাতিক জরিপ অনুযায়ী ক্রেডিট কার্ডের প্রবৃদ্ধির দিক থেকে বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে। এই হিসাবমতে বাংলাদেশে আমেরিকান এক্সপ্রেস কার্ড ব্যবহারে বছরে প্রবৃদ্ধি ২৪ শতাংশ। তিনি বলেন, একজন গ্রাহক ব্যাংক থেকে জামানতবিহীন ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণসুবিধা পেলেও ক্রেডিট কার্ডের বেলায় পাঁচ লাখ টাকার বেশি দেওয়া যায় না।