সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযু‌ক্তি বিশ্ববিদ‌্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে থাকা পু‌লিশ সদস‌্যদের দিকে ফুল এগিয়ে দেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। ফুল দিয়ে পুলিশকে ক্যাম্পাস ছাড়ার আহ্বান জানান তাঁরা। গতকাল বিকেলে
ছবি: আনিস মাহমুদ

প্রথমে তিন দফা দাবিতে গত বৃহস্পতিবার আন্দোলনে নেমেছিলেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) সিরাজুন্নেসা হলের ছাত্রীরা। গত রোববার বিকেলে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন। এ সময় পুলিশ শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা ও তাঁদের লক্ষ্য করে শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। এতে বিক্ষুব্ধ হন সাধারণ শিক্ষার্থীরাও। তাঁরা এখন এক দফা আন্দোলনে নেমেছেন। তাঁরা বলছেন, উপাচার্য পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।

গত রোববার পুলিশের লাঠিপেটা এবং শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেডে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। এরপর রাত সাড়ে আটটার দিকে উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের ঘোষণা দেন। সেই সঙ্গে আজ সোমবার দুপুর ১২টার মধ্যে হল ছাড়তে শিক্ষার্থীদের নির্দেশনা দেন।

তবে নির্দেশনা উপেক্ষা করে তিনটি ছাত্র হল ও দুটি ছাত্রী হলের অনেক শিক্ষার্থী হলে থেকে যান। তাঁরা উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

এদিকে শাবিপ্রবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে গতকাল ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন।

আরও পড়ুন

ঢাবিতে শাবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদের কুশপুত্তলিকা দাহ

বিক্ষোভ, উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও

গতকাল সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। সকালে ২০ থেকে ২৫ জন শিক্ষার্থী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সামনে থেকে বিক্ষোভ শুরু করেন। তাঁরা মিছিলসহ গোলচত্বরে এসে অবস্থান নেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও। দুপুরের পর থেকে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী কর্মসূচিতে যোগ দেন। বিকেলে তাঁরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। গতকাল দিবাগত রাত ১২টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী সেখানে অবস্থান নিয়ে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে স্লোগান দিচ্ছিলেন।

অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে থাকা পুলিশ সদস্যদের সামনে হাঁটু গেড়ে ফুল নেওয়ার অনুরোধ জানান শিক্ষার্থীরা। তাঁরা পুলিশকে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাওয়ার অনুরোধ করেন। তবে পুলিশ সদস্যরা শিক্ষার্থীদের অনুরোধে সাড়া দেননি।

শিক্ষার্থীরা বলেন, উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পুলিশ শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলা চালিয়ে অনেককে রক্তাক্ত করেছে। যে উপাচার্যের নির্দেশে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের রক্ত ঝরেছে, তাঁকে শিক্ষার্থীরা একমুহূর্তও আর ক্যাম্পাসে দেখতে চান না। তাঁরা শিক্ষার্থীবান্ধব নতুন উপাচার্য চান।

উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাওয়ের বেশ আগে বেলা একটার দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা উপাচার্যকে ক্যাম্পাসে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকর্মীদের বিষয়টি জানানো হয়।

বেলা দুইটার দিকে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি শুরু করেন। এখানে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গণস্বাক্ষর নেওয়া শুরু করেছেন। উপাচার্যকে অপসারণের দাবি জানিয়ে ওই গণস্বাক্ষরের আবেদন পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বরাবরে পাঠানো হবে।

সব প্রশাসনিক ভবনে তালা

বেলা সোয়া দুইটা থেকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা উপাচার্য, রেজিস্ট্রারের কার্যালয়সহ সব প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করেছে। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় চালু না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো প্রশাসনিক কার্যক্রমও চলতে দেওয়া হবে না।

এদিকে গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ মোহাম্মদ সামিউল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন সহকারী প্রাধ্যক্ষকে অবরুদ্ধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। তাঁরা হলের ভেতরে ঢুকলে শিক্ষার্থীরা বাইরে থেকে হলের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন। পরে অবশ্য বেলা আড়াইটার দিকে হলের পেছনের ফটক দিয়ে তাঁরা বেরিয়ে যান।

হলে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা বলেন, তাঁরা হল ছাড়বেন না। হল বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সরে আসতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আলমগীর কবির বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনেক শিক্ষার্থীই হল ছেড়েছেন। তবে কত শতাংশ শিক্ষার্থী হল ছেড়েছেন, সে তথ্য তিনি সঠিকভাবে জানাতে পারেননি।

শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার অনুরোধ

বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ তাঁর বাসভবনে দুজন গণমাধ্যমকর্মীর সঙ্গে কথা বলেন। তিনি তখন সব শিক্ষার্থীকে সিদ্ধান্ত মেনে হল ছাড়ার অনুরোধ করেন। অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার আশ্বাসও দেন তিনি।

উপাচার্যের অভিযোগ, অনেক বহিরাগত কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করছে। একটি চিহ্নিত স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব করছে দাবি করেন তিনি।

এদিকে রোববার শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় আট সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রক্টর আলমগীর কবির। তিনি বলেন, অধ্যাপক রাশেদ তালুকদারকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে। সদস্যসচিব রাখা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেনকে।

প্রসঙ্গত, সিরাজুন্নেসা হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে গত বৃহস্পতিবার রাতে হলের কয়েক শ ছাত্রী উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থানের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের সূচনা করেন। গত রোববার উপাচার্য জানান, প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদ ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেছেন। তাঁর জায়গায় নতুন প্রাধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের লাঠিপেটা এবং শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে সিলেট মহানগর বিএনপি, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রগতিশীল নেতারাসহ বিভিন্ন সংগঠন। এ ছাড়া গতকাল শাবিপ্রবির ৪৬৭ জন সাবেক শিক্ষার্থী এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। গতকাল বিকেলে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট সিলেট নগর শাখার উদ্যোগে নগরে বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। প্রায় একই সময়ে নগরের কোর্ট পয়েন্টে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে সিলেট জেলা ছাত্রদল।

প্রথম আলোর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদক জানান, শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ‘শাবিপ্রবির সাবেক শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তিনটি বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্রজোট বিক্ষোভ সমাবেশ করে৷ একই সময়ে বামপন্থী আটটি ছাত্রসংগঠনের উদ্যোগে আরও একটি বিক্ষোভ সমাবেশ হয়।

শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকে অমানবিক ও ন্যক্কারজনক বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী আবদুল মোতালেব ও অতুলন দাস৷ গতকাল এক যৌথ বিবৃতিতে তাঁরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ার সামনে অবস্থিত ঘৃণাস্তম্ভে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের কুশপুত্তলিকা স্থাপন করেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ-বিসিএল৷ এ সময় সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি গৌতম চন্দ্র শীল, সাধারণ সম্পাদক মো. মাহফুজুর রহমানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।