নতুন শিক্ষাক্রমে বই দেওয়া আটকে গেল

মাধ্যমিক ও প্রাথমিকের কর্মকর্তাদের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে শিক্ষাক্রমের রূপরেখাই অনুমোদিত হয়নি।

ফাইল ছবি

প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষায় বড় ধরনের পরিবর্তনের হাঁকডাক দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের কাজ শুরু করেছিল জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। কথা ছিল, এ মাসে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করে তার আলোকে জুনের মধ্যে নতুন বই লেখার কাজ শেষ করা হবে। এরপর বই ছাপিয়ে আগামী বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাঠ্যবই দেওয়া হবে।

কিন্তু এপ্রিল মাস শেষ হতে চললেও এখনো শিক্ষাক্রমের রূপরেখাই অনুমোদন করতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত নভেম্বরে রূপরেখাটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল এনসিটিবি। কিন্তু অনুমোদন না করে উল্টো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় পুরোনো শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রাথমিক স্তরের বই ছাপতে এনসিটিবিকে নির্দেশ দিয়েছে। এ রকম অবস্থায় আগামী বছর থেকে নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের বই দেওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে গেছে।

অভিযোগ উঠেছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং এনসিটিবির মাধ্যমিক ও প্রাথমিক অধিশাখার কর্মকর্তাদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

অবশ্য সমন্বয়হীনতা নেই দাবি করে এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেছেন, এখনো এ নিয়ে কাজ চলছে। করোনা ও লকডাউনের কারণে কিছুটা স্তিমিত হয়েছে। মে মাসে বোঝা যাবে আগামী বছর থেকে শুরু করা যাবে কি না।

জাতীয় শিক্ষানীতি, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টসহ (এসডিজি) বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ২০১৯ সালে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের কাজ শুরু করে এনসিটিবি। গত জানুয়ারিতে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন শিক্ষাক্রমে বই দেওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে এক বছর পিছিয়ে আগামী বছর থেকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এ লক্ষ্যে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাক্রম তৈরির কাজও অনেকটা এগিয়ে রাখে এনসিটিবি।

এত দিন প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষাক্রম আলাদাভাবে করা হলেও এবার তা সমন্বিতভাবে প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১০ ধরনের শেখার ক্ষেত্র নির্ধারণ করা হয়। এগুলো হলো ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। এতে প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা এক বছরের পরিবর্তে দুই বছর করা, দশম শ্রেণির আগে কোনো পাবলিক পরীক্ষা না নেওয়ার কথা রয়েছে। এ ছাড়া একজন শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, মানবিক নাকি ব্যবসায় শিক্ষায় পড়বে, সেটি ঠিক হবে উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে, যা এখন নবম শ্রেণিতে হয়।

নতুন শিক্ষাক্রমে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে প্রাক্-প্রাথমিক এবং প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি; মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী বই পাওয়ার কথা। আর ২০২৩ সালে অষ্টম শ্রেণি ও ২০২৪ সালে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নতুন শিক্ষাক্রমের বই দেওয়ার কথা। এরপর উচ্চমাধ্যমিকের বই দেওয়ার কথা।

সর্বশেষ ২০১২ সালে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকের শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়েছিল। সাধারণত পাঁচ বছর পরপর শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়।

এখনো এ নিয়ে কাজ চলছে। করোনা ও লকডাউনের কারণে কিছুটা স্তিমিত হয়েছে। মে মাসে বোঝা যাবে আগামী বছর থেকে শুরু করা যাবে কি না।
নারায়ণ চন্দ্র সাহা, চেয়ারম্যান, এনসিটিবি

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের জন্য সমন্বিতভাবে শিক্ষাক্রম তৈরির কাজ শুরু হলেও প্রাথমিকের প্রশাসন মনে করছে, এতে তাদের মতামতকে কম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাদের কর্তৃত্বও থাকছে না। এখানে বাইরের কিছু লোকের মতামতকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের দাবি, যেভাবে শিক্ষাক্রমের খসড়া রূপরেখাটি তৈরি করা হয়েছে, তা বর্তমান বাস্তবতায় মাঠপর্যায়ে প্রাথমিকের জন্য বাস্তবায়ন করাও কঠিন। এগুলো নিয়ে প্রাথমিকের প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে না বললেও ভেতরে-ভেতরে নতুন শিক্ষাক্রমের বিপক্ষে কাজ করেছেন।

নিয়ম হলো, এনসিটিবির খসড়া রূপরেখা জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) সভায় অনুমোদিত হতে হয়। প্রাথমিকের এনসিসিসির দায়িত্বে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের এনসিসিসির নেতৃত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু এনসিসিসি দীর্ঘদিনেও রূপরেখাটি অনুমোদন করতে পারেনি। এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এখন পরীক্ষামূলকভাবে আগামী বছর থেকে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা যায় কি না, সেটি নিয়ে আলোচনা চলছে।

অবশ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, রূপরেখাটি নিয়ে বোঝার কিছুটা ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। সেটি মিটে গেছে। তাঁরা এখনো আশাবাদী, আগামী বছর থেকে নির্দিষ্ট কয়েকটি বই নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী দিতে পারবেন।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন এবং সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলমের সঙ্গে চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে যেভাবে প্রত্যাশা ছিল, সেটি এনসিটিবি করতে পারেনি। কিন্তু তাঁদের লক্ষ্য হলো বছরের প্রথম দিকে বই দেওয়া।