শার্ট না দিয়ে এড়িয়ে যাবেন না

আঁকা: রাজীব
আঁকা: রাজীব

কাসাফাদ্দৌজা নোমান

এক সকালে মাহমুদ ভাই আর আমি মুখোমুখি।

: ভাই...

: বলো।

: একটু পর একটা চাকরির পরীক্ষা আছে।

: বাহ্! দাও পরীক্ষা। তোমাকে নিয়ে আমি খুব আশাবাদী।

: জি ভাই। তবে...

: তবে কী?

: পড়ালেখা করতে গিয়ে কাপড়চোপড় ধুইতে ভুলে গেছি। এখন পরতে গিয়ে দেখি একটাও পরিষ্কার শার্ট নাই। একটা শার্ট ধার দেবেন?

: তুমি আগের দুইটা শার্টও ফেরত দাও নাই!

: ভাই আসুন, অতীতের কথা ভুলে আমরা একটা সুন্দর আলোকিত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলি।

: আমার মা বলেছেন অতীত থেকে শিক্ষা নিতে।

: ভাই, আপনার মা তো দুঃখীদের সাহায্য করতেও বলেছেন। আর আপনার একটা শার্টই পারে আমার উজ্জ্বল ক্যারিয়ার গড়ে দিতে। প্লিজ ভাই, শার্ট না দিয়ে এড়িয়ে যাবেন না।

এড়িয়ে যেতে পারবেন না বলেই মাহমুদ ভাই একটু ভেবে বললেন, ‘তবে একটা শর্ত!’

: বলেন ভাই, প্লিজ। জীবন দিয়ে হলেও শর্ত রক্ষা করব।

: জীবন দিতে হবে না। শার্টটা ফেরত দিলেই হবে।

: অবশ্যই ফেরত দেব। আমি সব সময় শার্ট মেরে দিই নাকি?

: না, সব সময় শার্ট মারো না; বডিস্প্রে, স্যান্ডেলও মারো মাঝেমধ্যে।

ভাইয়ের কঠিন শর্তটি বিনা বাক্যে মানার পরও তিনি আমার সঙ্গে প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছিলেন। শেষ মুহূর্তে আমার শকুনে চোখে যদি ধরা না পড়ত তাহলে হয়তো বুকে আম আঁকা লাল টি-শার্ট পরে পরীক্ষা দিতে যেতে হতো আমাকে! তীব্রভাবে প্রতিবাদ করে বললাম, ‘ভাই, এইটা না। ওই যে নীল রঙের, ওইটা দেন।’

: এইটায় প্রবলেম কী?

: পারসোনালিটি ইস্যু। আমার পারসোনালিটির সঙ্গে যায় না এটা।

: তুমি পারসোনালিটির জন্য অনেক নিচে নামতে পারো!

এই পর্যায়ে এসে জ্ঞানের ভান্ডার খুলে দিতে হলো আমাকে। কেন প্রত্যেক মানুষের পারসোনালিটি আলাদা, কার সঙ্গে কোন রং যায় এবং আমার সঙ্গে কেন নীল রং যাবে, সেটা সফলভাবে বুঝিয়েও দিলাম।

মাহমুদ ভাই কাঁপা কাঁপা হাতে এবং তারও বেশি কাঁপা কাঁপা গলায় অনুনয় করে বললেন, ‘প্লিজ ভাই প্লিজ, এই শার্টটা মাইরা দিয়ো না। আমার খুব পছন্দের এইটা।’

: কেন ভাই, হবু ভাবি দিছেন?

: না।

: তাহলে যার হবু ভাবি হওয়ার কথা কিন্তু টেকনিক্যাল কারণে হয় নাই; তিনি দিছেন?

: কে দিছে সেইটা বড় কথা না। শার্টটা মারবা না, এটাই হইল আসল কথা। আগে তিনটা মারছ এবং শার্টটা ধুইয়া তারপর ফেরত দিবা!

২.

চাকরির পরীক্ষা শেষ করে এই শার্ট দিয়ে একটা বিয়ের দাওয়াত, আরেকটা অভিসারও সেরে ফেলেছি। এ ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কাজ, যেমন: চা খেতে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, দোকানে যাওয়াসহ যাবতীয় কাজ তিন দিন ধরে এই শার্ট পরেই করেছি। মাহমুদ ভাই যে বিষয়টা খেয়াল করছেন না, তা নয়। করছেন, কিন্তু কোনো এক কারণে কিছুই বলছেন না।

৩.

আরেকটা সকাল। মাথার ওপর মাহমুদ ভাইয়ের শার্ট না ধুয়ে দেওয়ার বোঝা নিয়ে আবার ভাইয়ের মুখোমুখি হলাম।

: ভাই।

: বলো।

: ওই যে চাকরির পরীক্ষা দিছিলাম না? আজকে সেখানে ভাইভা দিতে যাচ্ছি।

: শাবাশ! কংগ্রাচুলেশনস। যাও, অনেক দোয়া রইল।

: আসেন ভাই, এই খুশিতে কোলাকুলি করি।

: আসো।

কোলাকুলি শেষে বললাম, ‘জি ভাই, দোয়া তো আছেই। আর ভাই, আপনার কাছে কি আর শার্ট আছে? আমার না একটাও ধোয়া নাই। এমন একটা ভাইভার দিনে...।’

মাহমুদ ভাই কিছু একটা বলতে গিয়ে বললেন না। কিছু না বলে তিনি ওয়ার্ডরোব খুলছিলেন। আমি বললাম, ‘ভাই, অ্যাশ কালারেরটা দিয়েন। একজন স্পেশালিস্ট বলছেন, ভাইবায় হালকা রং পরা উচিত।’

ছিনতাইকারী অস্ত্র তাক করলে মানুষ যেভাবে পকেটের মোবাইল ফোন বের করে দেয়, ঠিক সেভাবে অ্যাশ কালারের শার্টটা আমার হাতে তুলে দিলেন মাহমুদ ভাই। আমি ধন্যবাদ দিয়ে শার্ট পরে দোয়া চেয়ে চলে গেলাম ভাইভা দিতে।

৪.

তারও কয়েক দিন পর। মাহমুদ ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার শার্টগুলা কবে ফেরত দিবা?’

আমি বিস্মিত হলাম, ‘শার্টগুলা?’

: হ্যাঁ। দুইটা শার্ট

: না ভাই, ভুল হচ্ছে। দুইটা না, একটা।

আমি ভুলে গেছি ভেবে তিনি বোঝাতে শুরু করলেন, ‘প্রথম দিন নিলা নীল শার্টটা। আর পরের দিন ছাই রঙেরটা।’

: হ্যাঁ। নীলটা দেওয়ার সময় আপনি পইপই করে বলেছেন, এই শার্টটা যাতে না মারি। রাইট?

: হ্যাঁ, রাইট।

: তাই ওইটা মারি নাই। সামনে যেদিন কাপড় ধুব, সেদিন ওইটা ধুয়ে আপনাকে দিয়ে দেব।

: আর ছাই রঙেরটা?

: ইমানে বলেন ওইটা নেওয়ার সময় আপনি না মারার কথা বলছেন?

: না, বলি নাই।

: তাই সেটা মেরে দিছি।

: কিন্তু বলতে হবে কেন?

: বলার ব্যাপার তো শুরু করছেন আপনি। আমি তো আপনার কথা শুনছি শুধু।

৫.

ঘটনার প্রায় আড়াই মাস পর নীল শার্টটা মাহমুদ ভাইকে ফেরত দিয়েছি। তার বেশ কয়েক দিন পর এক সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে আমাকে নীল শার্টটা খুলে দিয়ে বললেন, ‘আজকে থেকে এইটা তোমার।’

মাহমুদ ভাই ভীষণ রেগে আছেন। রাগের মাথার সিদ্ধান্ত যেকোনো সময় বদলে যেতে পারে। তাই দ্রুত শার্টটা নিয়ে গুছিয়ে রাখলাম। তারপর মাহমুদ ভাইয়ের সামনে বসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, শার্টটা আমাকে দিয়ে দিলেন যে?’

তিনি আরও রেগে বললে, ‘দিমু না? আজকে ছয় মাস পর শার্টটা পরে বাইরে গেছি। আসার সময় গলির দোকানে চা খাইতে গেছি। দোকানদার বলল, “নোমান ভাইয়ের এই শার্টটায় কিন্তু আপনারে খুব মানাইছে!”’