একঘেয়ে পড়াশোনা থেকে মুক্তি: ‘উইক প্ল্যান’ পদ্ধতিতে মেলে সফলতা
১৯৯৪ সালে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা’ ধারণা প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে জাতিসংঘ। তিন দশকের বেশি সময় পরও প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করা এখনো জটিল একটি বিষয়।
প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা এখনো নানা ধরনের বঞ্চনার মুখোমুখি হয়। অনেক সময় তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খুব কমই মিশতে পারে। সহায়ক কর্মী বা প্রয়োজনীয় সহায়তা না পাওয়ার কারণে অনেকের শিক্ষাজীবনও সীমিত হয়ে যায়। এতে শিক্ষকেরা প্রায়ই শিক্ষার্থীদের বৈচিত্র্যময় চাহিদা পূরণে হিমশিম খেয়ে যান।
‘বিকল্প শিখনপদ্ধতি’র শিকড়
বিংশ শতাব্দীর শিক্ষাবিদ মারিয়া মন্টেসরি (ইতালি), সেলেস্তাঁ ফ্রেনে (ফ্রান্স), পিটার পিটারসেন (জার্মানি) ও হেলেন পারখার্স্ট (যুক্তরাষ্ট্র) প্রবর্তিত শিক্ষা আন্দোলনগুলোই আধুনিক বিকল্প শিক্ষা মডেলের ভিত্তি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল প্রচলিত, একঘেয়ে ও বর্জনমূলক শ্রেণিকক্ষ পদ্ধতির বিকল্প তৈরি করা, যেখানে শিশুর শেখার স্বাধীনতা ও অংশগ্রহণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, ‘গড় শিক্ষার্থী’ ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে শ্রেণিকক্ষে বিকল্প শিখনপদ্ধতি প্রয়োগ করলে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ও শেখার মান বাড়ে। এটি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
‘উইক প্ল্যান ওয়ার্ক’: শিক্ষার্থীর হাতে নিয়ন্ত্রণ
এই আন্দোলনগুলো থেকে বিকশিত একটি পদ্ধতি হলো ‘উইক প্ল্যান ওয়ার্ক’, যেখানে শিক্ষার্থীরা এক সপ্তাহের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিজেদের কাজ সম্পন্ন করে। শিক্ষক (কখনো শিক্ষার্থীর সহযোগিতায়) সাপ্তাহিক পরিকল্পনা তৈরি করেন—যেখানে শেখার লক্ষ্য, করণীয় কাজ ও ধাপগুলো নির্ধারিত থাকে।
কানাডায় পরীক্ষামূলক প্রয়োগ
অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষায় বিশেষজ্ঞ এক গবেষক নোভা স্কোশিয়ার হ্যালিফ্যাক্স রিজিওনাল এডুকেশন সেন্টারের শিক্ষক হ্যারিয়েট জনস্টনের সঙ্গে মিলে নবম ও একাদশ শ্রেণির ইংরেজি ক্লাসে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেন।
প্রতিটি শিক্ষার্থীকে সপ্তাহের শুরুতে একটি ফোল্ডার দেওয়া হয়, যেখানে নির্দিষ্ট কাজ ও কার্যক্রমের তালিকা থাকে। তারা নিজের মতো করে কাজের অগ্রাধিকার ঠিক করতে পারে—এককভাবে বা দলগতভাবে। সপ্তাহ শেষে কাজ মূল্যায়ন ও আলোচনা হয়।
এই পদ্ধতিতে শিক্ষক সরাসরি পাঠদান কমিয়ে ‘কোচ’ বা ‘মেন্টর’-এর ভূমিকা পালন করেন। এতে শিক্ষক একান্ত সহায়তার প্রয়োজন এমন শিক্ষার্থীদের প্রতি বেশি মনোযোগ দিতে পারেন।
শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া
গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, অধিকাংশ শিক্ষার্থী এই পদ্ধতিকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। তারা বলেছে, এটি তাদের শেখার প্রতি আগ্রহ ও কৌতূহল বাড়িয়েছে এবং শেখার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে এসেছে। কেউ কেউ জানিয়েছে, এটি ভবিষ্যতের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের জন্যও তাদের প্রস্তুত করছে।
একজন সহকারী শিক্ষক যিনি একজন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে সহায়তা করছিলেন, বলেন—‘উইক প্ল্যান’ পদ্ধতিতে তার দায়িত্ব আরও স্পষ্ট হয়েছে; কী শেখাতে হবে, কখন করতে হবে—সবই নির্দিষ্ট। ফলে শ্রেণিকক্ষের কাজের গতি ও কাঠামো আরও সুসংগঠিত হয়েছে।
তবে কিছু শিক্ষার্থী সরাসরি নির্দেশনাপ্রধান শিখনপদ্ধতিকে বেশি পছন্দ করে। এদের জন্য শিক্ষক ধাপে ধাপে নির্দেশনা বা ‘স্ক্যাফোল্ডিং’ কৌশল প্রয়োগ করেন। এই পদ্ধতিতে কাজকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে সহজভাবে শেখানো হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা আরও আত্মনির্ভর হয়ে ওঠে।
গবেষকদের মতে, বিকল্প শিখন মডেল যেমন ‘উইক প্ল্যান ওয়ার্ক’ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দেয় ও অংশগ্রহণ বাড়ায়। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শেখার অধিকারকে বাস্তবে রূপ দেয়, যা সত্যিকার অর্থে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা’র পথে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।