লিফট কিনতে আট শিক্ষক ও কর্মকর্তা বিদেশ যাচ্ছেন

বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫টি লিফট কেনার কাজে চলতি মাসে একসঙ্গে সুইজারল্যান্ড ও স্পেনে যাচ্ছেন ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আটজন শিক্ষক ও কর্মকর্তা। তাঁদের ছয়জনেরই লিফট বিষয়ে কারিগরি জ্ঞান নেই। বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যেরও একই দলে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সমালোচনার মুখে তিনি যাচ্ছেন না।

লিফট কিনতে একসঙ্গে এত লোকের বিদেশযাত্রা নিয়ে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে-বাইরে সমালোচনা শুরু হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে সমালোচনা করে অনেকে মন্তব্য করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়টির একাধিক শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, লিফট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের টাকায় এত লোকের ইউরোপ সফর অনৈতিক। আবার সফরে যাওয়া আটজনের মধ্যে ছয়জনেরই লিফটের বিষয়ে কারিগরি জ্ঞান না থাকায় এটি কেবল ইউরোপ ভ্রমণই হবে। তাঁরা বলছেন, একান্ত প্রয়োজন হলে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-একজন যেতে পারেন। কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে, সেটা বিদেশ সফর ছাড়া আর কিছুই নয়।

এ বিষয়ে উপাচার্য এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান তাঁর না যাওয়ার বিষয়টি জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেছেন, যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁরা বিধি মেনেই যাচ্ছেন। তবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর যোগদানের আগেই প্রকল্পটি শুরু হয়। স্থানীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এক প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য বলেন, তাঁর সময়ে হলে তিনি এমন কমিটির অনুমোদন দিতেন না।

জাতীয় কবির নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এর আগে নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মোহীত উল আলম এবং তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য এ এম এম শামসুর রহমানের সময়ে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম অভিযোগে তখন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। একাধিক শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, এখনো নানা রকম অনিয়মের অভিযোগ উঠছে।

>

কারখানা সুইজারল্যান্ডে
চালান হবে স্পেন থেকে 
যাত্রা স্থগিত উপাচার্যের
অন্যরা দুই দেশে যাচ্ছেন

বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি বহুতল ভবন হচ্ছে। এ জন্য ১৫টি লিফট কেনার প্রক্রিয়া চলছে। একেকটি এক হাজার ও সাড়ে বারো শ কেজির ধারণক্ষমতাসম্পন্ন। মোট খরচ পড়ছে প্রায় ১৩ কোটি টাকা। এগুলো কেনা হচ্ছে শিন্ডলার এলিভেটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। আর এটি সরবরাহ করছে মেসার্স ক্রিয়েটিভ ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড। এসব লিফট কেনার জন্য কারখানা এবং প্রাক্‌–চালান কাজ দেখার জন্য ২০ থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত সুইজারল্যান্ড ও স্পেনে যাচ্ছেন আট শিক্ষক ও কর্মকর্তা। তাঁরা হলেন কোষাধ্যক্ষ জালালউদ্দিন, কলা অনুষদের ডিন মো. শাহাবুদ্দিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন সুব্রত কুমার দে, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার হুমায়ুন কবীর, প্রক্টরের দায়িত্বে থাকা উজ্জ্বল কুমার প্রধান, পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) হাফিজুর রহমান, উপপ্রধান প্রকৌশলী মাহবুবুল ইসলাম এবং অর্থ ও হিসাব শাখার পরিচালকের দায়িত্বে থাকা সহযোগী অধ্যাপক সোহেল রানা। তাঁদের বিমান ভাড়া, হাতখরচসহ সব ধরনের খরচ বহন করছে লিফট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। ভিসার জন্য সুইজারল্যান্ড দূতাবাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে যে ৯ জনের অনাপত্তিপত্র দেওয়া হয়েছিল, তাতে উপাচার্যের নামও ছিল। যদিও এখন আর তিনি যাচ্ছেন না।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আটজনের দুজন প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান ও মাহবুবুল ইসলাম। বাকিরা মূলত শিক্ষক ও প্রশাসনিক দায়িত্বে আছেন। হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গণপূর্ত অধিদপ্তরের কার্যপরিধি মেনেই তাঁরা যাচ্ছেন। আর সবার কারিগরি জ্ঞান থাকতে হবে, সেটাও ঠিক নয়। তাঁর মতে, স্থানীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যরাই যাচ্ছেন; যাঁরা প্রকল্পের কাজ তদারক করেন।

ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার হুমায়ুন কবির বলেন, এই সফরের বিষয়টি প্রকল্প প্রস্তাবেই ছিল। ওই কোম্পানির কারখানা সুইজারল্যান্ডে। আর চালান হবে স্পেন থেকে। এ জন্য তাঁরা দুই দেশে যাচ্ছেন।

তবে এ ধরনের সফরকে অনৈতিক বলছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মোটাদাগে সরকারি প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বপ্রাপ্তদের অনেকেই জনগণের অর্থায়নে সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার বিষয়টিকে সংস্কৃতিতে পরিণত করেছেন, যা দুঃখজনক। তাঁর মতে, বর্তমান সময়ে এ ধরনের প্রযুক্তিগত বিষয়ে কেনাকাটার জন্য বিদেশ ভ্রমণই প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, প্রযুক্তির সাহায্যে দেশে বসেই সব ঠিকঠাক আছে কি না, তা দেখা সম্ভব। তারপরও এগুলো চালানোর জন্য যদি প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়, তাহলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যেতে পারেন। কিন্তু সেটা না করে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের যাওয়ার বিষয়টি কোনোভাবে যৌক্তিক নয়।