এটা অপরাধ, কিন্তু সুরাহা নেই

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

শিক্ষার্থীর বয়স ও সক্ষমতা বিবেচনা করে শিক্ষাক্রম এবং তার আলোকে কোন শ্রেণির জন্য কয়টি বই হবে, তা ঠিক করে দেয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সে অনুযায়ী প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য অনুমোদিত পাঠ্যবই তিনটি, যা বিনা মূল্যে দিচ্ছে সরকার। কিন্তু রাজধানীর স্কুলগুলো সেই নিয়ম মানছে না। প্রথম শ্রেণিতে বিনা মূল্যের তিনটি বইয়ের বাইরে আরও কয়েকটি বই পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে।

অভিভাবকেরা জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বাড়তি বইয়ের তালিকা ঠিক করে দিয়েছে। তাদের তালিকা অনুযায়ী দোকান থেকে এসব বই কিনতে হচ্ছে। শুধু প্রথম শ্রেণি নয়, নবম শ্রেণি পর্যন্তই আছে বাড়তি বইয়ের এই বোঝা। প্রতিটি শ্রেণিতে দুই থেকে পাঁচটি পর্যন্ত অতিরিক্ত বই পড়ানো হচ্ছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) বলছে, নির্দিষ্ট শিক্ষাক্রমের বাইরে অতিরিক্ত বই ও নোট পড়ানো বা কিনতে বাধ্য করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু এ অপরাধ বন্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া ২০১৬ সালে উচ্চ আদালত শিশুর শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভারী ব্যাগ বহন নিষিদ্ধ করেছিলেন।

মাউশির কাছেই ভিকারুননিসা নূন স্কুল, আরও কাছে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল। এ দুটিসহ রাজধানীর আর সব নামী–দামি স্কুলে চলছে এ অপরাধ। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে সরেজমিন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবুল হোসেন দাবি করেন, তাঁরা মাউশির নির্দেশমতোই চলছেন। আগের চেয়ে বাড়তি বই কমানো হয়েছে। এখন এক-দুটি করে বাড়তি বই পড়ানো হচ্ছে। তাঁর ভাষায়, ‘যা না পড়ালেই নয়।’

তবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের এই বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার বিস্তর ফারাক। স্কুল থেকেই পাওয়া বইয়ের তালিকায় দেখা যায়, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছবি আঁকার বইসহ পাঁচটি বাড়তি বই কিনতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। অথচ এই শ্রেণিতে এনসিটিবির নির্ধারিত বই তিনটি। অতিরিক্ত বইয়ের তালিকায় আছে Radiant Cursive Writting-2, শিশুপাঠ বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা, Radiant English Grammer Translation & Composition-2, ধর্মশিক্ষাবিষয়ক বই। এর বাইরে আমার ছবি আঁকো নামে আরেকটি বই আছে।

>

শিশুর কাঁধে বইয়ের বোঝা। অতিরিক্ত বই পড়ানো নিষেধ হলেও স্কুলগুলো মানছে না। বই কিনতে হয় নির্দিষ্ট দোকান থেকে।

বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুল, মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ওয়াইডব্লিউসিএ, উদয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ রাজধানীর আরও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত বই পড়ানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলের বইয়ের তালিকা অনুযায়ী প্রথম শ্রেণিতে (স্ট্যান্ডার্ড-১) এনসিটিবির তিনটি বইয়ের বাইরে বিভিন্ন নামে আরও আটটি বই রয়েছে। রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে গিয়ে জানা গেছে, সেখানে প্রতিষ্ঠান থেকে লিখিতভাবে বাড়তি বইয়ের কোনো তালিকা নেই। তবে অঘোষিতভাবে ইংরেজি ও বাংলা গ্রামার বিষয়ে দুটি বই কেনা ও পড়ানোর রেওয়াজ চালু হয়ে গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, শহরের প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি স্কুল ও কিন্ডারগার্টেনগুলোতেই এই প্রবণতা বেশি। অভিভাবকেরা বলছেন, বাড়তি বইয়ের এই বোঝা শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ তৈরি করছে। কিন্তু বিদ্যালয়ের চাপে তাঁরা বাধ্য হচ্ছেন। অতিরিক্ত বইয়ের মধ্যে বাংলা ও ইংরেজি গ্রামারের পাশাপাশি আরও বিভিন্ন ধরনের বই রয়েছে। অথচ জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত আলাদা কোনো ব্যাকরণ বই থাকার কথা নয়।

উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে কথা হয় ইংরেজি ভার্সনে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর মায়ের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের সময়ে যেসব বিষয় ওপরের ক্লাসে পড়তে হতো, সেগুলোই এখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়তে দেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত বইয়ের মাধ্যমে। এতে সন্তানের ওপর চাপ পড়ছে।

এ বিষয়ে সরকার কী করছে, জানতে চাইলে মাউশির মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বই কিনতে হয় নির্দিষ্ট দোকান থেকে
অভিভাবকদের অভিযোগ, অতিরিক্ত বইগুলো নির্ধারিত দোকান থেকেই কিনতে হয়। এতে দামও বেশি লাগছে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. আবুল হোসেনের সইয়ে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের বইয়ের যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, তার নিচে বইয়ের প্রাপ্তিস্থান হিসেবে স্কুল ক্যানটিনের কথা লেখা রয়েছে। এতে বলা হয়, তালিকার সব বই, খাতা, স্টেশনারি ড্রেস, ব্যাগ ও জুতা সুলভ মূল্যে স্কুল ক্যানটিনে পাওয়া যাবে। একেবারে শেষে বলা হয়েছে, অভিভাবকেরা ইচ্ছে করলে নিজ ব্যবস্থাপনায় যেকোনো দোকান থেকেও বই কিনতে পারবেন।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ অভিভাবককে বিদ্যালয়ের ক্যানটিন–সংলগ্ন দোকান থেকেই এসব বই কিনতে হচ্ছে। সম্প্রতি বিদ্যালয়টির বাইরে সন্তানের অপেক্ষায় বসে থাকা এক অভিভাবক জানান, তিনি ক্যানটিন থেকেই বই কিনেছেন।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ধানমন্ডি শাখায় সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছাত্রীর অভিভাবক বললেন, স্কুল–নির্ধারিত দোকান থেকেই তাঁদের বই কিনতে হচ্ছে। এই বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে চারটি অতিরিক্ত বই রয়েছে। এগুলো হলো, আধুনিক বাংলা ভাষাতত্ত্ব ব্যাকরণ ও রচনা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারিক, অ্যাডভান্স লারনার্স কমিউনিকেটিভ ইংলিশ গ্রামার অ্যান্ড কম্পোজিশন ও গ্রামোসম্যান ভূচিত্রাবলি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বেইলি রোডে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের মূল ক্যাম্পাসের পাশের দোকান থেকেই বেশির ভাগ অভিভাবক বই কিনছেন। একটি দোকানে গিয়ে জানা গেল, প্রথম শ্রেণির জন্য এনসিটিবির বাইরে চারটি বাড়তি বইয়ের দাম ৭০০ টাকা। বিদ্যা ভবন নামে পাশের আরেকটি দোকানে গিয়ে জানা গেল, চতুর্থ শ্রেণির জন্য চারটি বাড়তি বইয়ের দাম ৯৯০ টাকা।

এ বিষয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের অধ্যক্ষ ফওজিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানে ঐতিহ্য অনুযায়ী আগে থেকেই এটি হয়ে আসছে। তারপরও তিনি এ বিষয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে বসে আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবেন।

ইস্কাটন এলাকায় অবস্থিত বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলের বইয়ের দাম আরেকটু কম। সেখানে প্রথম শ্রেণির বাড়তি বইয়ের দাম ৪০০ টাকা এবং চতুর্থ শ্রেণির বইয়ের দাম ৫০০ টাকা। বিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী একটি দোকান থেকে এসব বই কেনা যাচ্ছে।

‘অসময়ে’ মাউশির নির্দেশ নিয়ে প্রশ্ন
মাউশি গত ২০ জানুয়ারি তাদের অধীন মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে লেখা এক নির্দেশনাপত্রে বলেছে, কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট শিক্ষাক্রমের বাইরে শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত বই বা নোট পড়তে ও কিনতে বাধ্য করছে, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নির্দেশনাপত্রে এসব কার্যক্রম বন্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু একাধিক অভিভাবক প্রথম আলোকে বলেছেন, মাউশির নির্দেশটি ভালো কিন্তু এমন সময়ে নির্দেশনাপত্রটি দেওয়া হলো, যখন বই কেনা প্রায় শেষ। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে, এটি লোক দেখানো নির্দেশনা। আমরা যারা স্কুলের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী ইতিমধ্যে বই কিনে ফেলেছি, সেসব বই কি ফেরত নিয়ে টাকা ফেরত দেবে? নাকি এসব বই-ই পড়তে হবে?’

অবশ্য মাউশির মহাপরিচালক প্রথম আলোকে বললেন, এই নির্দেশনা তো আর নতুন নয়, আগের নির্দেশনাটিই এখন আবার মনে করে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে এই নির্দেশনার আগেও যাঁরা এসব কাজ করছেন, সেগুলোও অপরাধ। এ জন্যও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাসলিমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, এনসিটিবি–নির্ধারিত পাঠ্যবইয়ের বাইরে আরও পাঠ্যবই পড়ানোর প্রয়োজন নেই। এখন এমনিতেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিসহ নতুন নতুন কিছু বিষয় যুক্ত হয়েছে। ফলে এমনিতেই বেশি বই পড়তে হয়, সেখানে আরও বাড়তি বই শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ তৈরি করছে। আবার কোথাও বেশি বই পড়ানো হচ্ছে, কোথাও কম পড়ানো হচ্ছে। এতেও বৈষম্য তৈরি হচ্ছে।