মাশরুম চাষে ক্ষতিকর ছত্রাকের সংক্রমণ রোধে নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেন আইইউবির শিক্ষক জীবুন্নাহার

মাশরুমছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের গ্রামে কিংবা শহরে—সবখানেই এখন মাশরুম চাষের প্রসার। রান্নাঘরে পুষ্টিকর সংযোজন থেকে শুরু করে প্রান্তিক পরিবারের আয়—সবখানেই জায়গা করে নিয়েছে এই ফসল। কিন্তু চাষিদের মাথাব্যথার বড় কারণ একটাই—ক্ষতিকর ছত্রাকের আক্রমণ। কখনো একটি স্পন ব্যাগ, আবার কখনো পুরো খামারই নষ্ট করে দেয় এই অদৃশ্য শত্রু। ফলে ভেস্তে যায় চাষিদের স্বপ্ন।

এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করেছেন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (আইইউবি) সহযোগী অধ্যাপক জীবুন্নাহার খন্দকার। প্রায় তিন বছর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তিনি উদ্ভাবন করেছেন নতুন এক পদ্ধতি, যা ক্ষতিকর ছত্রাকের বিস্তার ঠেকাবে, অথচ মাশরুমের ফলন অক্ষুণ্ন রাখবে। এখানে ক্ষতিকারক কোনো ছত্রাকনাশক ব্যবহার হয় না বলে পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্যও এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ।

জীবুন্নাহার খন্দকার বলেন, ‘যেহেতু মাশরুম নিজেও ছত্রাক ও ক্ষতিকারক পদার্থ শোষণ করে, তাই আমার লক্ষ্য ছিল এমন কিছু তৈরি করা, যা চাষিরা সহজে ব্যবহার করতে পারবেন। ফলনও ঠিক থাকবে, আবার ছত্রাক সংক্রমণের ঝুঁকিও কমবে।’

স্পন ব্যাগ বা স্পন প্যাকেট হলো বিশেষ প্লাস্টিক ব্যাগে প্রস্তুতকৃত সাবস্ট্রেট, যেখানে মাশরুমের বীজ (ইনুকুলাম) রোপণ করা হয়। এখান থেকেই মাশরুমের বৃদ্ধি শুরু হয়। সাবস্ট্রেট বলতে বোঝায় মৃত জৈব উপাদান—যেমন কাঠের গুঁড়া, ধানের খড় বা অন্যান্য জৈব পদার্থ, যা মাশরুমের খাদ্য ও বৃদ্ধির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাই একটি ব্যাগে সংক্রমণ হলে তা দ্রুত পাশের ব্যাগগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় কাঠের গুঁড়ার মতো জৈব উপাদানে খুব দ্রুত ছত্রাক জন্মায়। প্রচলিত নিয়মে সাবস্ট্রেটকে অটোক্লেভ বা পাস্তুরাইজেশনের মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করা হয়। কিন্তু এই প্রচলিত পদ্ধতিতে একবার সংক্রমণ দেখা দিলে তা আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। ছত্রাকনাশক ব্যবহার করলে সাময়িক সমাধান মেলে, তবে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি থেকেই যায়।

আরও পড়ুন

জীবুন্নাহার খন্দকারের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে সরাসরি কাঠের গুঁড়া নয়, ব্যবহার করা হয় আংশিক কম্পোস্ট কাঠের গুঁড়া। ৫০ কেজি শুকনো কাঠের গুঁড়ায় পানি মিশিয়ে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ আর্দ্রতা রেখে একেকটি স্তূপ আকারে সংরক্ষণ করা হয়। চটের বস্তা দিয়ে স্তূপ ঢেকে রাখা হয়, যাতে ভেতরের তাপমাত্রা ৫০ থেকে ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না হয়। প্রতি তিন দিন পরপর স্তূপ উল্টেপাল্টে দেওয়া হয় এবং প্রয়োজনে পানি যোগ করা হয়। ৯ থেকে ১২ দিনের মধ্যে কাঠের গুঁড়া আংশিক কম্পোস্টে পরিণত হয়। এই কম্পোস্টে অবশ্যই নাইট্রোজেন যোগ করে দিতে হবে।

গবেষক দল
ছবি: সংগৃহীত

এই প্রক্রিয়ায় কাঠের গুঁড়ার ‘ফ্রি সুগার’ কমে যায়, যা ক্ষতিকর ছত্রাকের বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। পাশাপাশি সাবস্ট্রেটের ছিদ্রতা বাড়ে, বাতাস চলাচল ও পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। একই সঙ্গে পুষ্টি উপাদান সহজলভ্য হয়। ফলে মাশরুমের জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়, অথচ ক্ষতিকর ছত্রাক বিস্তারের সুযোগ পায় না।

সহযোগী অধ্যাপক জীবুন্নাহার বলেন, ‘আসলে আমি প্রকৃতির প্রক্রিয়াকেই অনুকরণ করেছি। মাশরুম প্রকৃতিতেই আংশিক পচা জৈব উপাদানে জন্মায়। সেই পরিবেশটাই আমরা বৈজ্ঞানিকভাবে পুনর্গঠন করেছি।’

আরও পড়ুন

জীবুন্নাহার বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি এবং এমএস ডিগ্রি লাভ করেন। ২০১৪ সালে তিনি জাপানের নাগাসাকি ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০১৬ সাল থেকে তিনি আইইউবিতে কর্মরত। প্রায় দুই দশক ধরে মাশরুম নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি। তাঁর গত তিন বছরের গবেষণায় সহায়তা করেছেন ঢাকার অদূরে সাভারে অবস্থিত মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট ও আইইউবির লাইফ সায়েন্সেস বিভাগের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী।

আইইউবির স্কুল অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সেসের ডিন কে আয়াজ রাব্বানী বলেন, বাংলাদেশে টেকসই কৃষির জন্য এ ধরনের উদ্ভাবন খুব জরুরি। চাষিরা যদি এই পদ্ধতি গ্রহণ করেন, তাহলে তাঁদের আয় বাড়বে, উৎপাদন বাড়বে এবং খাদ্য নিরাপত্তায়ও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

আরও পড়ুন